বইমেলার চতুর্থ দিন মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় -ফোকাস বাংলা
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং জাতির মেধা ও মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে 'অমর একুশে বইমেলা'। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল বাঙালির প্রাণের এই বইমেলার চতুর্থ দিন। এদিনও বইপ্রেমীদের প্রাণের সঞ্চার ঘটে মেলায়। সেইসঙ্গে মেলায় বাড়ছে নতুন নতুন বইও। বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী এদিন মেলায় এসেছে ৪৭টি নতুন বই।
এদিন বইপ্রেমীদের সরব উপস্থিতির পাশাপাশি অভিভাবকের হাত ধরে মেলায় আসা শিশু-কিশোররা বেশ উচ্ছ্বসিত। তাদের চঞ্চল বিচরণে খুঁজে নিচ্ছে পছন্দমত বইয়ের স্টল আর বই। তাদের মুখের ভাষা, চোখের চাহনি আর ভালোবাসাময় পদক্ষেপ দেখে মনে হয়, তারা যেন একুশের চেতনায় নতুন করে ঋদ্ধ হতে মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে এসেছে। তাদের সবার মনে ও চেতনায় যেন নাড়া দিয়েছে প্রাণের এই মেলা।
প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে মেলায় আগতদের তলস্নাশি করেই তবে মেলায় প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন তারা। মেলায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রকাশনা স্টলের বিক্রয়কর্মীদের সাথে চতুর্থদিনের মেলা কেমন যাচ্ছে জানতে চাওয়া হয়। তাদের কয়েকজন জানান, গত তিন দিনের তুলনায় চতুর্থদিনে বেচাকেনা তুলনামূলক বেশি।
এখনও সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব করার সময় না আসলেও সোমবারের তুলনায় বেচাকেনাতে আশাবাদী কয়েকজন প্রকাশক। তারা বলছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিগগিরই মেলা সাফল্যের পথে হাঁটা শুরু করবে। তবে চতুর্থদিনেও মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকাশকদের বিক্রি ছিল অপরিবর্তিত। শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনীর পাশাপাশি মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকাশনীগুলোতে বেচাকেনা বাড়বে এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন এই শ্রেণীর অনেক প্রকাশক।
অন্যদিকে, শিশুকর্নারের শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশকরা জানাচ্ছেন, প্রতিবছর শুক্রবার ও শনিবার এবং ছুটির দিনগুলোতে আমাদের ৬
বিক্রি ভালো হয়। এবারও প্রতিদিন বই বিক্রি ভালো হচ্ছে। আমরা আশাবাদী এই জন্য যে, অন্যবারের তুলনায় বিক্রির দিক থেকে এবার অনেক ভালো একটা মেলা শেষ করতে পারব।
এদিকে, মেলার চতুর্থদিনে বিকালে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'কুমুদিনী হাজং : জুইলৗ তারা, তারালা জুই' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পাভেল পার্থ। আলোচনায় অংশ নেন মতিলাল হাজং এবং পরাগ রিছিল। সভাপতিত্ব করেন আবু সাঈদ খান।
প্রাবন্ধিক বলেন, ঔপনিবেশিক জুলুমবিরোধী কৃষক আন্দোলনের এক সংগ্রামী নেত্রী কুমুদিনী হাজং। তিনি ঔপনিবেশিক শাসন, বৈষম্য, সার্বভৌমত্ব, আত্মপরিচয়, ন্যায্য মজুরি, কৃষি, ভূমি, অরণ্য কিংবা সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নগুলো জারি রেখে লড়াই চালিয়ে গেছেন। কুমুদিনী হাজং ঔপনিবেশিক জুলুম, যুদ্ধ, মহামারি, দাঙ্গা, দখল, লুণ্ঠন, পরিবেশ-গণহত্যা ও কর্তৃত্ববাদী ইতিহাসের সাক্ষী। ব্রিটিশ আমলে অন্যায় টংক প্রথার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা টংক আন্দোলনে বহু হাজং নারী-পুরুষ শহিদ হন। তবে এই আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম কুমুদিনী হাজং। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে ব্রিটিশ জুলুম, জাতিরাষ্ট্রিক জাত্যাভিমানের রক্তদাগের ভেতর দিয়ে তাই কুমুদিনীকে পাঠ করা জরুরি।
আলোচকদ্বয় বলেন, টংক আন্দোলনে কুমুদিনী হাজং-এর মতো আরো নাম না জানা অনেক নারীর প্রবল অংশগ্রহণ ছিল। তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষক সমিতি গঠন করেছেন, নারী-পুরুষদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। খুব অল্প বয়স থেকেই অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কুমুদিনী হাজং। সমৃদ্ধ কৃষিজীবনের স্বপ্ন নিয়ে কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষক সমাজকে সকল কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রেখে টংক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সংগ্রামী জীবন, কর্ম ও অবদান নিয়ে নানামুখী গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
সভাপতির বক্তব্যে আবু সাঈদ খান বলেন, রাজনৈতিক ধারার বাইরেও নানা জনবিদ্রোহ, জন-আন্দোলন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করেছিল। টংক আন্দোলনও ছিল সেরকমই একটি আন্দোলন যার অন্যতম সংগ্রামী নেত্রী ছিলেন কুমুদিনী হাজং। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে এদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার সংগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষা সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে হবে।
মঙ্গলবার লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি আতাহার খান, কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন- কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি সোহেল হাসান গালিব। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইশরাত শিউলি এবং কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী স্বর্ণময়ী মন্ডল, অনুপম হালদার, নুরিতা নুসরাত খন্দকার, দিদারুল করিম এবং অমৃত চন্দ্র বণিক। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রাজু চৌধুরী (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), দীপঙ্কর রায় (অক্টোপ্যাড) এবং মো. অনিক মাহমুদ (গিটার)
আজ বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'হোসেনউদ্দীন হোসেন' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমেদ মাওলা। আলোচনায় অংশ নেবেন শহীদ ইকবাল ও আবুল ফজল। সভাপতিত্ব করবেন মঈনুল আহসান সাবের।