মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

টানা তিন দিন দূষিত শহরের শীর্ষে ঢাকা

যাযাদি ডেস্ক
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
টানা তিন দিন দূষিত শহরের শীর্ষে ঢাকা
টানা তিন দিন দূষিত শহরের শীর্ষে ঢাকা

বায়ুদূষণ বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রতি বছর শীতকাল এলে আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের বায়ু। গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক বায়ুদূষণের হটস্পট হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। দূষণ থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছে না এই অঞ্চলের দেশগুলো। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়ও বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণের মাত্রা। তথ্য অনুযায়ী, টানা তৃতীয় দিন বায়ুদূষণে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে ঢাকা। গত রোববার ও সোমবার সকালের মতো মঙ্গলবারও বিশ্বের ১২৩ শহরের মধ্যে বায়ুদুষণে ঢাকার এ অবস্থান ছিল বলে জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। প্রতিষ্ঠানটি বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে আইকিউ এয়ারের মানসূচকে ঢাকার গড় বায়ুর মান ছিল ২৪৮। বায়ুর এ মানকে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে ধরা হয়। একই সময়ে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে যেসব এলাকায় বায়ুর মান মারাত্মক দূষিত ছিল, সেগুলো হচ্ছে- কল্যাণপুর (৪৩৯), মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিং-২ (৩৯৪) ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস (৩৭৯)।

আইকিউ এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, কোনো অঞ্চলে পরপর তিন দিন বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকলে সেখানে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ঢাকায় গত জানুয়ারিতে একাধিক দিন বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি হয়েছে।

শুধু ঢাকা নয়, মঙ্গলবার অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর বায়ুর মানও ছিল নাজুক। এর মধ্যে চট্টগ্রামে বায়ুর মান ১৪০, রাজশাহীতে ১৬৭ ও খুলনায় ১৬৯।

সেই সতর্কবার্তায় ঢাকাবাসীর উদ্দেশে আইকিউ এয়ারের পরামর্শ, বাইরে বের হলে সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। আরও একটি পরামর্শ, ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে।

ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২ দশমিক ৫-এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৫ গুণ বেশি। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে একটি দিনও নির্মল বায়ু পায়নি ৬

রাজধানীবাসী। দূষণসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে যত বায়ুদূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় দুই দশক ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা। বায়ুদূষণের কারণে রাজধানী ঢাকায় গড় আয়ু কমছে। শিশুমৃতু্যর হারেও বিশ্বে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। বায়ুদূষণে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৫ শতাংশ। মানুষের মৃতু্যর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বিপজ্জনক অবস্থায় বসবাস করছে নগরবাসী। এমনকি বৃষ্টির দিনেও কখনো কখনো বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষে উঠে আসে ঢাকার নাম।

পরিবেশ দূষণ বন্ধে পরিবেশবাদী সংগঠন ও নাগরিক কমিটির আন্দোলনের মধ্যে হাইকোর্ট একাধিকবার সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে 'নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ' বা 'বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ট্রান্সফরমেশন' (বেস্ট) শীর্ষক একটি মেগা প্রকল্প করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে (আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রায় ছয় হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এই অর্থ প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ, জনবল বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের কাজেই খরচ হয়েছে। লোক দেখানো পানি ছিটানো আর মাঝে-মধ্যে দূষণকারী ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক বায়ুমান নির্ধারণী কেন্দ্র স্থাপন এ নিয়েও নয়-ছয়ের অভিযোগ রয়েছে।

এরপরও রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিবদের তলব পর্যন্ত করেন হাইকোর্ট। জলবায়ুর তহবিলের টাকা অপাত্রে অর্থ ব্যয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে (অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত) ঢাকায় বায়ুদূষণ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বাতাসের গুণমান বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ধরেই খুব খারাপ থাকে এবং শীতকালে তা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এই সময়টায় উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হয়। তখন বিষাক্ত বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এ কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ক্যানসার, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু এবং বয়স্করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণা ভেসে বেড়ায়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে এই পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি। বায়ুদূষণে রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্‌নতায় ভুগছেন। বায়ুদূষণজনিত ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ বাড়ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শামসুল কবীর চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বাতাসে এই বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি। দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিন গুণ বেশি। শহরে বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি বলা হয়, অতিসূক্ষ্ন বস্তুকণা ২.৫। যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিদিন ফুসফুসের মাধম্যে দুই হাজার লিটারের বেশি বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্বাস গ্রহণের সময়েই ফুসফুসে ঢুকছে দূষিত বস্তুকণা। দূষিত বায়ুর এই বস্তুকণা মানুষের মৃতু্যকে ত্বরান্বিত করছে।

নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দূষণের জন্য দায়ী পুরনো ইটভাটা, দূষণকারী যানবাহন ও শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ বেশি হয় এমন স্পটগুলোতে বায়ুমান পরিবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের দূষণের কারণে আমরা ২৪ শতাংশ দূষণে ভুগছি, এ ছাড়াও জেলাগুলোর উন্নয়ন কাজের দূষণ ঢাকায় আসছে। গ্রামাঞ্চলে লাকড়ির চুলার ধোয়ায় দূষণ বাড়ছে। বছরে একাধিকবার ফসল উৎপাদনের কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। শিল্পকারখানার দূষণ ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে