রোজায় ভোগ্যপণ্য নিয়ে সমস্যা হবে না, আশ্বাস বাণিজ্য উপদেষ্টার

প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে 'বণিক বার্তা' আয়োজিত পলিসি কনক্লেভে বক্তব্য রাখেন -ফোকাস বাংলা
আসন্ন রোজায় ভোগ্যপণ্য নিয়ে আশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাজারের সাথে যারা অংশীজন আছেন, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজারকে আমরা ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিপত্তি হয়নি এবং আমি এটাও আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই রমজানেও ইনশা আলস্নাহ সমস্যা হবে না।" আশ্বাসের কারণ ব্যাখ্যা করে উপদেষ্টা বলেন, 'আমাদের আমদানিকৃত যে ভোগ্যপণ্য- চিনি, তেল, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, আলু...আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, আলস্নাহর রহমতে এর কোনো সংকট বাজারে নাই।' রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে 'বণিক বার্তা' আয়োজিত পলিসি কনক্লেভে বক্তব্য রাখছিলেন তিনি। আয়োজনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল 'খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান'। উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, 'আমরা প্রতিযোগিতা কমিশনকে পুরোপুরি স্বাধীন করে দিতে চাই। বাজারে যাতে প্রতিযোগিতাবিরোধী কোনো কর্মকান্ড না ঘটে, মন্ত্রণালয়ের সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ যেন না থাকে, সেদিকে আগাতে চাই।' তিনি বলেন, 'আমাদের নীতিগুলো ধনিক শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য হয়েছে। ভোক্তা বা সাধারণ মানুষকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এসব নীতি গ্রহণ হয় না। বিগত ১৫ বছর দেশে উলেস্নখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যদি সেটি না হয় তাহলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? আমরা কার কাছ থেকে কর আদায় করব?' আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, 'আমার মনে হয় শেখ হাসিনার নামে একটা পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া দরকার। কারণ বায়তুল মোকাররমের খতিবের যদি পালিয়ে যাওয়া লাগে, তাহলে বুঝতে হবে কী পরিমাণ ধ্বংস করা হয়েছে সবগুলো খাত। ব্যাংকগুলোকে গত ১৫ বছরে ক্রিমিনাল ইনস্টিটিউট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংককে ধ্বংস করা হয়েছে। আইনে দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) ধ্বংস করা হয়েছে ১৫ বছর ধরে। ১২ হাজার কোটি টাকার একটা অপারেশন করে মাত্র ১৪২ জন।' টিসিবির তালিকা নিয়ে অনিয়ম হয়েছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'উপকারভোগীদের সংখ্যা এক কোটি, শুনতে ভালোই লাগছে। কিন্তু আমরা যখন প্রাথমিকভাবে যাচাই করেছি, দেখলাম ৪৩ লাখ ভুয়া। আমার ধারণা, এটি এক্সট্রা লেভেলে যাচাই করলে আরো ২০-২৫ লাখ ভুয়া পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরা টিসিবির টেন্ডারে অংশ নেন না। আমি অনুরোধ করছি আপনারা অংশ নিন।' স্বল্প নয়, দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন উলেস্নখ করে উপদেষ্টা বলেন, 'ধান সংগ্রহে সরকারি সংগ্রহটা সীমিত করতে চাই। সরকারি সংগ্রহটা আমদানিনির্ভর হওয়া উচিত। তাহলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।' অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মো. আবদুর রহিম খান বক্তব্য রাখেন। প্যানেল আলোচনায় প্রবিধান ও সরকারি সংস্থা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন চেয়ারপারসন এএইচএম আহসান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন চেয়ারম্যান (সচিব) ড. মইনুল খান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ। পণ্য আমদানি, সরবরাহ ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, মেঘনা গ্রম্নপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল, টি কে গ্রম্নপের গ্রম্নপ ডিরেক্টর মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার। অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন ও বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা করেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ওবায়েদ উলস্নাহ আল মাসুদ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। খুচরা বাজার নিয়ে বক্তব্য রাখেন এসিআই লজিস্টিকস লিমিটের (স্বপ্ন) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদ আহমেদ রাসেল। ভোক্তা অধিকার নিয়ে আলোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এবং কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। এছাড়া খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাসহ সারা দেশের দুই শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এদিকে সেমিনারে বাজারে মুক্ত অর্থনীতির মূলনীতির কোনও অস্তিত্ব নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, বাস্তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি বলতে কিছু নেই, যা আছে তা অলিগোপলি। বেশিরভাগ বাজার ও পণ্য উৎপাদন কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির মূলনীতি অনুযায়ী বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে, ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বেশি হবে এবং তথ্য উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বাজার কয়েকটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, প্রতিযোগিতাও নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন ও সরকারেরও দায় আছে বলে তিনি উলেস্নখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে উৎপাদক ও ভোক্তারা কেউই যৌক্তিক দামে পণ্য কিনতে পারছে না। এর সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বড় অংশ কৃষক। এর মানে উৎপাদনে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার হচ্ছে, যা কৃষকদের ক্ষতি করছে। অথচ তারা সঠিক দামও পাচ্ছে না। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, একসময় গবেষণা ও সরকারি নীতিমালায় কৃষি ও খাদ্যখাত গুরুত্ব পেতো। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে কৃষিখাত গুরুত্ব হারাতে থাকে। একইসঙ্গে গত দেড় দশকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো) কার্যকরভাবে কাজ করছে না, মন্ত্রণালয়গুলোর নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে, সব কিছু একক কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি আদালতও ওপরের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে, যা গত দেড় দশকে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়াটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন তিনি।