চলতি সপ্তাহে ঢাকা ছিল বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় দূষণকারী শহর

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ঢাকায় ভয়াবহ বায়ুদূষণ!

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
ঢাকার বায়ুদূষণের চিত্র -ফাইল ছবি
শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ঢাকায় বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর আশপাশের ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বাতাসে। ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা দিনের পর দিন ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। গত দুই দশক ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীবাসী। বায়ুদূষণের কারণে এই সময়টায় শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এ সময়টায় উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হয়। তখন বিষাক্ত বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ক্যানসার, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন শিশু এবং বয়স্করা। বৃহস্পতিবার বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় শহরের স্বীকৃতি পায় রাজধানী ঢাকা। সপ্তাহের শুরু থেকেই বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) এর তথ্যে দিনের বেশিরভাগ সময় ঢাকার দূষণের স্কোর ছিল ১৯০। যার অর্থ হচ্ছে এ শহরের বাতাসের মান 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' এবং এ অবস্থায় শহরের সবাই বিপদজনক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। ২২২ স্কোর নিয়ে প্রথম ছিল মিশরের কায়রো শহর আর ১৭০ স্কোর নিয়ে তৃতীয় ছিল কঙ্গো। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা দেখা যায়, সারাদেশে ইটভাটা আছে প্রায় ৮ হাজার। আর ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে সাড়ে ৭০০টির বেশি ইটভাটা। ইটভাটাগুলো প্রতি মৌসুমে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ায়। ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস হয়। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। এছাড়া নির্মাণকাজ, যানবাহন, সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলার মাধ্যমে ১৩ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্রসহ পস্নাস্টিক পোড়ানোর ফলে ৫ শতাংশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের দূষিত বায়ু পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার হয়ে দূষিত বায়ুর স্তর ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ২৪ শতাংশ দূষণে ভুগছে ঢাকা। নাসার তথ্য অনুযায়ী গত ১৮ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, রাজধানী ঢাকায় মেগা প্রকল্প চলমান থাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় পুরনো গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণ ছড়াচ্ছে। ইটভাটাগুলোকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইট পুরানোর ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুদূষণ বন্ধ হবে না। পুরনো ইটভাটাগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ দূষণ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকায় নির্মাণকাজ হচ্ছে। বিশেষ করে ঘর-বাড়ি সংস্কার কাজ হচ্ছে। ঢাকায় এখনো বিল্ডিং কোড মেনে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে না। কেউ পরিবেশ সংরক্ষণের কথা মাথায় নিচ্ছে না। প্রকাশ্যে রাস্তায় ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রেখে কাজ করছেন। এতে চারপাশে বায়ুদূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী পানি দিয়ে ভেজানো হয় না। এ জন্য বায়ুদূষণ বাড়ছে। বায়ুদূষণ তৈরি করে ও দূষণ উৎপাদনকারী শিল্পকে আইনগতভাবে শিল্পকারখানা স্থাপনে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বায়ুদূষণ ঠেকাতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নীতি, আইনি কাঠামো নির্মোহভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হতে হবে। তাছাড়া বায়ুদূষণের চলমান পদক্ষেপসমূহ বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর এর বড় প্রভাব রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের দূষণসহ উন্নয়নকাজ, ইটভাটার দূষণ, একাধিকবার ফসল উৎপাদন, শিল্পকারখানার দূষণ ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব। এতে বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন। বায়ুদূষণ রোধে আন্তঃসীমান্ত সমাধান করতে হবে। পরিবেশবিদ আবু রায়হান কামাল বলেন, রাজধানী ঢাকার বাতাসে বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি। দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিন গুণ বেশি। শহরে বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয়, অতিসূক্ষ্ণ বস্তুকণা ২.৫। যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিদিন ফুসফুসের মাধ্যমে দুই হাজার লিটারের বেশি বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্বাস গ্রহণের সময়েই ফুসফুসে ঢুকছে দূষিত বস্তুকণা। দূষিত বায়ুর এই বস্তুকণা মানুষের মৃতু্যকে ত্বরান্বিত করছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম। এছাড়া রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্পকারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে। তিনি জানান, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। ২০২৩ জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩। এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ রশিদ উদ্দীন বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ণ বস্তুকণা যার ব্যাস সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোটটির (পিএম ২.৫) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়, নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিলস্নাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.৮ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩.১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১, মাইক্রোগ্রাম অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসব মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান মাত্রার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট শহর। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ভারত ও নেপালের সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতজুড়ে দক্ষিণ এশিয়া থেকে দূষিত বায়ু ঢাকাতে পরিবাহিত হয়। শীতকালে (নভেম্বর-জানুয়ারি) উত্তর-পশ্চিম বায়ুর প্রভাবে দূষিত পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে বিকলাঙ্গতা, শ্বাসযন্ত্রের দুর্বলতাজনিত কারণে মৃতু্য, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যানসার, ডায়াবেটিসসহ নিউমোনিয়ার মতো ছোঁয়াচে রোগ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো চলছে প্রকাশ্যে। গণপরিবহণের পেট্রোল পোড়া বস্ন্যাক কার্বন মিশ্রিত হচ্ছে, তখন তা পরিপূর্ণভাবে দূষণের একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। সেই মিথেন গ্যাস বন্ধের জন্য পরিচ্ছন্নকর্মীরা আগুন জ্বালান। এতে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়।