লাইফ সাপোর্ট থেকে নদীকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব, দাবি পরিবেশবিদদের

যথাযথ উদ্যোগে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে বুড়িগঙ্গা

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
রাজধানীর ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা এখন দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে সয়লাব -যাযাদি
বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এক সময় গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী, এখন ঢাকা শহরই গিলে খাচ্ছে নদীটাকে। বিষে ভরে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে অস্তিত্ব মিলেছে ভারী ধাতুর। মৃতপ্রায় নদীটির পানির ল্যাব পরীক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, ভারী ধাতু, লেড, ক্রোমিয়ামের প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। যার প্রভাবে পানির অক্সিজেনও কমে গেছে। এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলছেন, বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করা সহজ কাজ নয়। এর কারণ হিসেবে তিনি উলেস্নখ করেছেন নদীর নিচে তিন থেকে চার আস্তরের পলিথিন জমে থাকার কথা। যে কারণে নদীতে ড্রেজিং করাও সম্ভব না। তবে, পরিবেশবিদরা বলছেন, লাইফ সাপোর্টে থাকলেও ফুরিয়ে যায়নি মৃতপ্রায় নদীটির বেঁচে থাকার আশা। শক্ত হাতে দেখভাল করা আর যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে নদীটি। সরেজমিন দেখা যায়, দখল-দূষণে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাণ যায়যায়। দুই পাড়ে সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই। ক্রমাগত পলিথিন, শিল্পকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল, মবিল, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্যসহ গৃহস্থালির নানা বর্জে নিক্ষেপের কারণে নদীর পানি হয়েছে নিকষ কালো, দুর্গন্ধযুক্ত। নদী বাঁচাতে সরকারের তোড়জোড়েরও শেষ নেই। এরপর কাটছে না জটিলতা। সরকার কেন নদীকে বাঁচাতে চেয়েও পারছে না- সম্প্রতি এমন এক প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'বুড়িগঙ্গা নদী অত সহজে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। নদীর নিচে তিন থেকে চার আস্তরের পলিথিন পড়ে আছে। এ কারণে সেখানে ড্রেজিং করা সম্ভব না। তাই আমাদের সবার উচিত পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা।' সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না নদীদূষণ। ফলে এই বৃহত্তর নগরীর মানুষের দুঃখ-কষ্টেরও শেষ নেই। রাজধানীতে বসবাসকারী প্রায় দুই কোটি মানুষের পয়ঃবর্জ্য, কলকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য প্রতিনিয়ত মিশছে নদীর পানিতে। যে কারণে বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেন প্রায় শূন্যের কোটায়। গবেষকরা বলছেন, নদীর প্রতি লিটার পানিতে মিলেছে ৫ থেকে ৪৫ পিচ মাইক্রো পস্নাস্টিকের অস্তিত্ব। পানিতে আর্সেনিকের আদর্শ মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৫৮ থেকে ৯৮.৪৪ মিলিগ্রাম। ভয়াবহ লেড ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে আদর্শ হলেও এখানে মিলেছে ৫০.১২ থেকে ৬৬.৫৪ মিলিগ্রাম। ক্রোমিয়াম প্রতি লিটারে আদর্শ মাত্রা ৫ মিলিগ্রাম হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৭০.১৫ থেকে ১২০.৮৬ মিলিগ্রাম। ক্যাডমিয়াম প্রতি লিটারে আদর্শ মাত্রা ৩ মিলিগ্রাম হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৮.০২ থেকে ১১.৮৯ মিলিগ্রাম। আর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে হলেও এখন তা নেমেছে .০২ মিলিগ্রামে। যার ফলে নদীর পানিতে প্রাণের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। নদীপাড়ের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, 'এই নদীতে ছোডবেলায় কত সাঁতার যে কাটসি হিসাব নাই। সারাদিন নদীর পানিতেই থাকতাম। মাঝেমধ্যে দলবল নিইয়্যা বড়শি লইয়্যা মাছ ধরতাম। মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক আগের কথা। তহন কী সুন্দর পানি ছিল এইহানে। দুই-তিন হাত উঁচু উঁচু ঢেউও ছিল। নদীতে মাছ আর মাছ।' আগানগর-বাদামতলী ঘাটের মাঝি রমিজ উদ্দিন বলেন, 'যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করি তখন নদী পার হতে লাগতো আট আনা। বর্তমানে জনপ্রতি ১০ টাকা করেই পান। কিন্তু তার নিকট এখনো সেই আট আনার দিনই অপেক্ষাকৃত মধুর। বর্তমানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এই নদীতে। নেই আগের সেই জৌলুসও। শখের বশেও কেউ আর বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ভিড় করে না। নদীর বুকে চর জাগে না বলে কাশফুলেরও দেখা নেই দীর্ঘবছর।' জিনজিরার স্থানীয় বাসিন্দা সাহিদুল হক, ওমর ফারুক, দিদার হোসেনসহ কয়েকজন জানান, মানুষ যেমন হৃৎপিন্ড না থাকলে বাঁচে না, তেমনি নদী না থাকলে ঢাকাও বাঁচানো সম্ভব নয়। যেভাবে বুড়িগঙ্গা নদী মরছে, আর যেভাবে কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এ ঢাকা। নদী রক্ষা করতে না পারলে স্বাভাবিক জীবন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ও নদী গবেষক মীর মোহাম্মদ খান বলেন, 'বুড়িগঙ্গার পানি অবশ্যই বিষাক্ত। সেটা তো স্বাভাবিকভাবে দেখলেই বুঝা যায়। আর এই নদীতে মাছ থাকলেও সেটা খেলে বিভিন্ন রোগ হতে পারে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা তদারকি সংস্থা কেউই বুড়িগঙ্গার এমন পরিণতির জন্য দায় এড়াতে পারে না। তবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়ে লাইফ সাপোর্ট থেকে এ নদীকে বাঁচিয়ে তোলার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি বলে জানান এই বিশেষজ্ঞরা।