পুলিশ সংস্কার কমিশনের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮.৭ শতাংশ মানুষ বাহিনীটিকে 'রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত' করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি নেওয়ার কারণে তোপের মুখে থাকা পুলিশকে 'পাল্টে ফেলতে' গঠিত কমিশন গত রোববার এ ফল প্রকাশ করেছে।
'কেমন পুলিশ চাই' শিরোনামে এ সমীক্ষা শুরু হয় গত ৩১ অক্টোবর। নির্ধারিত ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তাতে অংশ নেন ২৪ হাজার ৪৪২ জন।
প্রাপ্ত ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আইনের শাসনে অনুগত ও নিরপেক্ষ পুলিশ চেয়েছেন ৮৬.২ শতাংশ এবং দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ চেয়েছেন ৮৪ শতাংশ মানুষ।
এ সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছর, যাদের হার ৪২.৭ শতাংশ। উত্তরদাতাদের মধ্যে চাকরিজীবী ৩৬.৪ শতাংশ, ছাত্র ২৭.২ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ৭.৬ শতাংশ।
উত্তরদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন ঢাকা জেলা থেকে, ২০.৩ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম, অংশগ্রহণকারীদের ৭.৫ শতাংশ সেখানকার, আর কুমিলস্নার ক্ষেত্রে এই হার ৫ শতাংশ।
পুলিশের কোন ক্ষেত্রে সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি, এমন প্রশ্নের উত্তরে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান' চেয়েছেন ৮৯.৫ শতাংশ উত্তরদাতা। পুলিশের দুর্নীতি বন্ধ চান ৭৭.৯ শতাংশ উত্তরদাতা এবং গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো অপরাধের জন্য পুলিশের জবাবদিহি ও শাস্তি চেয়েছেন ৭৪.৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
'ভুয়া' ও 'গায়েবি মামলা' দিয়ে বিরোধীদের দমনের 'অপসংস্কৃতির' অবসান চেয়েছেন ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা। ভুয়া বা গায়েবি মামলার ভয়ভীতির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা চেয়েছেন ৮১.৯ শতাংশ।
বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দল-মত দমনে মাত্রারিক্ত বল প্রয়োগকারী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়েছেন ৭১.৫ শতাংশ মানুষ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সভাসমাবেশ আয়োজনে মহানগর পুলিশের অনুমতি নেওয়ার যে বিধান আছে সেটিকে মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বলে মনে করেন ৫১.৮ শতাংশ উত্তরদাতা।
সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদে সভাসমাবেশ আয়োজন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন আইন ১৯৭৬ এর ২৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী পুলিশ কমিশনারকে 'জনস্বার্থে' সর্বোচ্চ ৩০ দিন সমাবেশ স্থগিত করার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
উত্তরদাতাদের শতকরা ৮২.৫ শতাংশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারাকে 'সহজে অপব্যবহারযোগ্য' বিধান বলে মনে করেন। ৪৬.২ শতাংশই ধারাটির যুগোপযুগী সংস্কার চান। এক্ষেত্রে ৩৯.৭ শতাংশ উচ্চ আদালতের সুপারিশ মতে ৫৪ ধারায় বিধান সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে 'নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে' জানিয়ে উত্তরদাতাদের ৯১.৭ শতাংশ ধারাটির সংস্কার চেয়েছেন।
'ক্ষমতার অপব্যবহার' রোধে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ চেয়েছেন ৮০.২ শতাংশ।
এছাড়া পুলিশের বিভিন্ন গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে 'জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯'-এর সেবা সন্তোষজনক বলে মত দিয়েছেন ৫৬.৬ শতাংশ, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স কার্যক্রমে ৩২.৪ শতাংশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৪৪.৯ শতাংশ।
ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারের সেবায় ৪২ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং কার্যক্রমে অসন্তুষ্টির হার ৪৫.৮ শতাংশ, অনলাইন জিডি কার্যক্রম সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন ৪৪.৯ শতাংশ মানুষ।
'নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ডেস্কের' সেবায় ৩৮.৪ শতাংশ, সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত নারীদের জন্য হেল্পলাইনে ৩৫.৫ শতাংশ এবং ই-ট্রাফিকিং প্রসিকিউশনে ৩৭.৮ শতাংশ উত্তরদাতা সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন।
গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে পূর্ণাঙ্গ 'পুলিশ সংস্কার কমিশন' গঠন করা হয়।
একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিসহ ৯ সদস্যের এই কমিশন 'জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ' পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার কাজের জন্য সুপারিশ করবে বলে সেখানে জানানো হয়। ৯০ দিনের মধ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করার কথা রয়েছে।