ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে কাটছেই না জটিলতা

নিবন্ধন না থাকায় হরহামেশাই ছিনতাই অপরাধ কমাতে নিবন্ধনের আওতায় আনা জরুরি

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক নিয়ে জটিলতা কাটছে না। অনিবন্ধিত এসব যানবাহনকে কেন্দ্র করে ছিনতাই ও হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এ সংক্রান্ত দুই শতাধিক ছিনতাই মামলা এবং ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় চালক হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত শতাধিক মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। যানবাহনটিকে কেন্দ্র করে অপরাধ ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে এর স্থায়ী সমাধান জরুরি বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০২০ সালে বৈদু্যতিক ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন আমদানি করার অনুমতি দেয়। এ সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে। যা ছিল পরস্পরবিরোধী। প্রজ্ঞাপনে বার বার চার্জ দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারিচালিত চার চাকা ও তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলে বলা হয়। অথচ প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, তবে বাইসাইকেল ও রিকশায় কোনো রিচার্জেবেল ব্যাটারি বসানো হলে, তা চালানো যাবে না। ২০২২ সালের জুনে ব্যাটারিচালিত বা রিচার্জেবেল যানবাহন অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ধরনের যানবাহন ব্যবহারে মানুষ যাতে উৎসাহিত হয়, এ জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এমনকি পরিবেশবান্ধব এসব যানবাহন সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে সচেতনামূলক কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, রাস্তার পাশে সিএনজি, অকটেন, পেট্রোল বা ডিজেল পাম্পের মতো চার্জিং স্টেশন স্থাপন করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। সূত্র বলছে, যদিও শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের সেই পরকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। আপত্তি উঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে। কারণ, সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক চললে আশঙ্কাজনকহারে দুর্ঘটনা বাড়বে। পালস্না দিয়ে বাড়বে সংখ্যা। এসব যানবাহন সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের জন্য বৈধ লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সে প্রক্রিয়াও চলছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সারাদেশে এ ধরনের যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সরকারের কোনো দপ্তরে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বর্তমানে দেশ এক প্রকার সয়লাব হয়ে গেছে এ ধরনের যানবাহনে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক প্যাডেল রিকশার চেয়ে দ্রম্নতগতিতে চলে। ব্যস্ত মানুষ সময় বাঁচাতে ব্যাটারিচালিত যানবাহনে চলাচল করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এসব যানবাহন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যানবাহনগুলো অনিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। তারা হরহামেশাই এসব যানবাহন ছিনতাই করছে। তারা যাত্রীবেশে ওঠে চালককে জিম্মি করে বা অজ্ঞান করে বা হত্যা করে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে যানবাহনগুলো। ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই অপরাধীরা চালককে হত্যা করে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। লুট করা যানবাহন রাখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গোপন গ্যারেজ রয়েছে। সেসব গ্যারেজে গাড়ির রং পরিবর্তন করে বা কাঠামোগত পরিবর্তন করে অন্য জেলায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। অপরাধীদের অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ, এসব যানবাহনের নিবন্ধন না থাকায় অনেক সময় হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া চালককে পর্যন্ত শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক ছিনতাইয়ের দুই শতাধিক আর ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ার সূত্র ধরে চালক হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত শতাধিক খুনের ঘটনার তদন্ত চলছে। পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছেই ইজিবাইক ও অটোরিকশা চালক হত্যাকান্ডের ৮৫টি মামলা তদন্তের জন্য রয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, যাত্রী হিসেবে ভাড়া নিয়ে অপরাধীরা চালককে খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়ে গাড়িটি ছিনতাই করেছে। অথচ জোরপূর্বক ছিনতাই করে। জোরপূর্বক ছিনতাইকালে বাধা দিলেই অপরাধীরা চালককে হত্যার পর নির্জন জায়গায় ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। অনেক সময় নিহত চালকদের পর্যন্ত শনাক্ত করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে। ছিনিয়ে নেওয়া গাড়ি কেনার সিন্ডিকেট আছে। তারা কিনে নিয়ে রং বা কাঠামোগত পরিবর্তন করে অন্য জেলায় বিক্রি করে দিচ্ছে যানবাহনগুলো। চোরাই গাড়ির অধিকাংশই বিক্রি করা হয় প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে। পিবিআই বলছে, এসব যানবাহনকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) কাজ করতে পারে। এসব যানবাহনকেন্দ্রিক অপরাধ কমাতে নিবন্ধনের বিকল্প নেই। র্ যাব সূত্রে জানা গেছে, ধারাবাহিক অভিযানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইকারী কাম খুনী চক্রের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়াদের তথ্য মতে, তাদের মূল টার্গেট ইজিবাইক। সারাদেশেই ইজিবাইক ছিনতাইকারী চক্র আছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জকেন্দ্রিক ইজিবাইক ছিনতাই চক্র সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তারা কেরানীগঞ্জ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া গাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করে দেয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৮২টি। এআরই'র সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন, বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এসব যানবাহনের ব্রেকিং সিস্টেম ও কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। যে কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন। বিশেষ করে পায়ে চালিত রিকশায় দুই থেকে চারটি ব্যাটারি বসানোর ফলে এসব যানবাহন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। যে কারণে এসব যানবাহনকে মোড় নেওয়ার সময় উল্টে যেতে দেখা যায়। সার্বিক পর্যালোচনায় অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতেই হবে। যদিও বাস্তবে কাজটি অত্যন্ত কঠিন। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় নাকি ১২ লাখের বেশি এই রিকশা চলাচল করে। চলতি বছরের ৫ আগস্টের পরবর্তী সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অসংখ্য নতুন রিকশা রাজধানীতে ঢুকেছে। কারণ, ঢাকায় তুলনামূলকভাবে রোজগার বেশি। এটি একটি অত্যতম কারণ। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের বিকল্প নেই। জীবিকার কথা বলে রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়ে কোটি কোটি জনগণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা উচিত হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার বিকল্প কোনো উপায় বের করার বিষয়ে ভেবে দেখতে পারে। যদিও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্র বলছে, যে হারে ঢাকায় এই যানবাহনের দাপট বেড়েছে, এতে বন্ধ করা সহজ হবে না। অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেছেন, ২০০৩ সালে চীন থেকে পুরোপুরি বাহন হিসেবে ইজিবাইক আসত। কিন্তু ২০১২-২০১৩ সাল থেকে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে বাহনটি। চীন থেকে যেগুলো এসেছে, সেগুলোর অনেকটাই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তৈরি। তবে দেশে মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ করে যেসব ব্যাটারিচালিক রিকশা তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত না। যে কারণে এসব যানবাহনে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (পূরকৌশল) বিভাগের শিক্ষক, সড়ক ও দুর্ঘটনা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ এ ধরনের যানবাহন অবশ্যই একটি নীতিমালার মধ্যে আনা জরুরি। সারাদেশে ইতোমধ্যেই ব্যাঙের ছাতার মতো এসব যানবাহন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। বিআরটিএ-এর উচিত, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। এ ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে দুর্ঘটনা ও অপরাধ বাড়বে। প্রসঙ্গত, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই চলতি বছরের জুনে কয়েক দফায় ঢাকার মিরপুর, পলস্নবী, কালশী, মিরপুর-১১, রামপুরা, ডেমরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, দুটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ১০টি যানবাহন ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ, পথচারী ও বিক্ষোভকারীসহ অন্তত ১৫ জনের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় চারটি মামলা হয়। ওই সময় ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পতিত সরকার ঢাকার নির্ধারিত সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার অনুমতি দেয়। সম্প্রতি আবারও উচ্চ আদালত ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এরই প্রেক্ষিতে গত ২১ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে আসছে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক ও মালিকরা। রোববারও বিক্ষোভকারী চালকরা ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা অবরোধ করে ভাঙচুর করেছে। রেলপথ অবরোধ করেছে। ঢাকার মহাখালীতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের ক্লাবের (রাওয়া) সামনে থাকা এটিএম বুথ ভাঙচুর করেছে। মহাখালী রেলপথ অবরোধ করার কারণে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে।