যমুনার বুকে রেল সেতুতে চলল পরীক্ষামূলক ট্রেন

এখনই পূর্ণ গতি পাচ্ছে না ট্রেন বাণিজ্যিক যাত্রা জানুয়ারিতে

প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল ও ভূঞাপুর প্রতিনিধি
যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দিয়ে মঙ্গলবার পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো হয় -যাযাদি
প্রমত্তা যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দিয়ে মঙ্গলবার পরীক্ষামূলকভাবে (ট্রায়াল) ট্রেন চালানো সফল হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের দীর্ঘতম এই রেল সেতুর ওপর দিয়ে এদিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে পরীক্ষামূলক ট্রেনটি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশের পূর্বপাড় থেকে ছেড়ে সিরাজগঞ্জের পশ্চিম অংশে যায়। তবে ট্রেনের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু ট্রেনের পূর্ণ গতি পেতে আরও দুই মাস সময় লাগবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সেতু সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ট্রেনের তিনটি বগি নিয়ে একটি ইঞ্জিন সকাল ৯টা ৪২ মিনিটে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশের পূর্বপাড় থেকে ছেড়ে সিরাজগঞ্জের পশ্চিম অংশে যায়। পরে ট্রেনটি ১০টা ৪১ মিনিটে পুনরায় পূর্বপাড়ে ফিরে আসে। সিরাজগঞ্জ প্রান্ত থেকে অপর একটি ট্রেন একটি ইঞ্জিন ও তিনটি বগি নিয়ে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে পূর্ব প্রান্তে আসে এবং ১০টা ২৯ মিনিটে পশ্চিম প্রান্তের দিকে যাত্রা শুরু করে। পরীক্ষামূলক ট্রেন দুটি প্রথমে ১০ কিলোমিটার বেগে চলাচল করলেও পরে তা ৪০ কিলোমিটার বেগে চালানো হয়। এ সময় ট্রায়াল ট্রেনের চালক ছিলেন মাইনুল ইসলাম এবং সহকারী চালক ছিলেন আব্দুস সালাম। ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, প্রকল্প ব্যবস্থাপক মার্ক হবি, নির্মাণ ব্যবস্থাপক মি. ইপোমাফসু, ট্রাক এক্সপার্ট নাকাজিমা, নিরাপত্তা প্রকৌশলী কামরুল হাসান চৌধুরী প্রমুখ। ট্রায়াল ট্রেনের চালক মইনুল ইসলাম বলেন, 'সিরাজগঞ্জের মানুষ হিসেবে আমি গর্বিত আজকে দেশের বৃহৎ সেতুতে ট্রায়াল ট্রেন চালানোর জন্য। প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল সেতুর ওপর প্রথম ট্রেনটি আমিই চালাবো সেটা ট্রায়াল বা উদ্বোধনের সময়। এর ফলে আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে আমিই প্রথম নতুন এই রেল সেতুতে ট্রেন চালালাম।' সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা চালু না হলে ট্রেনের গতি কমে সময়ের অপচয় হওয়া ছাড়াও নিরাপত্তার দিকে ঘাটতি থাকবে। এ থেকে জটের আশঙ্কাও রয়েছে। সূত্র মতে, পুরনো নন-ইন্টারলিঙ্ক ব্যবস্থা যত দিন চালু থাকবে তত দিন নয়া সেতুতে ট্রেনের গড় গতিসীমা অনেক কম থাকবে। এ ব্যবস্থায় ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে গেলে মারাত্মক শিডিউল বিপর্যয় ঘটবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু পূর্ব ও পশ্চিম রেল স্টেশনে শুরু থেকে কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বা কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) চালু করা সম্ভব হচ্ছে না- ফলে প্রথমদিকে সেতুতে পূর্ণ গতি অর্থাৎ ১২০ কিলোমিটার বেগ পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গড়িমসি এবং ভারত থেকে প্রযুক্তিপণ্য আমদানিতে জটিলতার কারণে সেতুর দুই পাশের স্টেশনে শুরু থেকে সিবিআইএস চালু করা যাচ্ছে না। ফলে এ সময়টায় ট্রেনের গতি কম থাকছে। রেলওয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে যে মিটারগেজ রেললাইন রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৭০ কিলো-নিউটন/মিটার ওজন বহন করা সম্ভব। তাই ট্রেনে বেশি বগি যুক্ত করার সুযোগ নেই। এছাড়া এক লাইনের সীমাবদ্ধতা থাকায় বেশি ট্রেন চালানোও সম্ভব নয়। মাত্র ২০ কিলোমিটার গতিতে প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু পাড় হতে ২৫ মিনিট লেগে যায়। দুই পাড়ের স্টেশনে সিগন্যালের জন্য ট্রেনগুলোকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সব মিলিয়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। আগামী জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু উদ্বোধন হলে এ রুটে গড়ে সময় বাঁচবে এক ঘণ্টা। ক্রসিংয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। দেশের বৃহত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, সেতুটির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। তবে মঙ্গলবার সকালে রেলওয়ে সেতু দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, নতুন এই রেল সেতু দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও সিবিআইএসের কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪২-৪৪ শতাংশ। এ পদ্ধতি চালু করতে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তায় সেতু উদ্বোধন হওয়ার পরে আরও দু-তিন মাস লাগতে পারে। তিনি আরও জানান, এছাড়া সিগন্যাল সিস্টেম সাধারণত স্টেশনে থাকে- সেতুতে তো আর থাকে না। তাই গতি পেতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আগামী মার্চ মাসের শেষ দিকে কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বা কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) চালু করা সম্ভব হবে। আপাতত প্রথাগত নন-ইন্টারলিঙ্ক ব্যবস্থায় ট্রেন চালাতে হবে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এর ব্যয় তখন ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ দশমিক ৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ দশমিক ৯৬ কোটি টাকায়। এর ১২ হাজার ১৪৯ দশমিক ২ কোটি টাকা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত। কিন্তু প্রথম সংশোধনে এ সময়সীমা ডিসেম্বর ২০২৪ করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়।