শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
রিভিউ কমিটির দাবি, এমন সব তথ্য-প্রমাণ মিলেছে, এতে অনেক চুক্তি বাতিল ও নতুন করে আলোচনা হতে পারে

বিদু্যৎ খাতে চুক্তি নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

রেজা মাহমুদ
  ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিদু্যৎ খাতে চুক্তি নিয়ে জটিলতা বাড়ছে
বিদু্যৎ খাতে চুক্তি নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

আওয়ামী লীগ সরকারের বিদু্যৎ খাতে করা বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে জটিলতা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও বিদু্যতের সরবরাহ ঠিক রেখে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই হাইকোর্ট ৭টি বিদু্যৎ চুক্তি তদন্তের রিভিউ কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে। আর এই কমিটির দাবি চুক্তিগুলোর বিষয়ে এমন সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে অনেক মেগা চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

যদিও এসব চুক্তি এমনভাবে করা হয়েছে, যার বেশিভাগেরই কোনো ক্লোজিং বা এক্সিট রাখা হয়নি। শুধু তাই নয়, গত সরকার এসব সংস্থার কাছে বিদু্যৎ উৎপাদন ও আমদানি বাবদ বিপুল বকেয়াও রেখে গেছে। ফলে এ ধরনের চুক্তি থেকে বেরিরে আসা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

মূলত আওয়ামী লীগ সরকার এসব চুক্তির প্রায় সবই বিশেষ আইনে করেছে। ফলে এর ভেতরকার তথ্য গোপন ছিল। যতটুকু সরকার জানিয়েছে ঠিক ততটুকুই জানা গেছে। আদালতের নির্দেশে যেহেতু তদন্ত শুরু হয়েছে তাই চুক্তির বিভিন্ন পর্যায়ের সব ধরনের তথ্য-উপাত্তসহ কোন পরিস্থিতিতে চুক্তিগুলো করা হয়েছে সব জানা যাবে। এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ে যে তথ্য রয়েছে তাতেও অনেক চুক্তি দেশের স্বার্থবিরোধী তা প্রমাণে যথেষ্ট বলেও মনে করছেন এ খাতের সাবেক কর্মকর্তারা।

তবে বর্তমান বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাত অনেকটাই আমদানি নির্ভর হয়ে গেছে। তাই রাতারাতি চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসলেও এর বিকল্প কি- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেখা গেছে ভারতের আদানি পাওয়ার কিংবা দেশের অন্য বড় কোনো বিদু্যৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ঘাটতি হলেই দেশব্যাপী তীব্র লোডশেডিং করতে হয়। এমনকি বিদু্যৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি কয়লা বা গ্যাস আমদানি কিছুটা বিঘ্নিত হলেই বিদু্যৎ উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভোক্তাসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এছাড়া চুক্তির বর্ণিত ধারা ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ সংস্থাগুলোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগও থাকবে। এমন বাস্তবতায় এসব চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

এদিকে, ভারতের আদানি ও সামিটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশসহ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে। ইতোমধ্যেই সামিটের এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি বাতিলসহ সংস্থাটির বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও চুক্তি পর্র্যালোচনায় গঠিত কমিটি সরকারের কাছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বড় সব বিদু্যৎ উৎপাদন চুক্তি পর্যালোচনায় সহায়তার জন্য স্বনামধন্য আইন ও তদন্তকারী আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। সর্বশেষ গত রোববার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি সরকারকে এই পরামর্শ দেয়। তবে চুক্তিগুলোর বিস্তারিত রিভিউ করেত তাদের আরও সময়ের প্রয়োজন বলে জানানো হয়।

তাদের দাবি, এখনই চুক্তিগুলোর বিষয়ে এমন সব প্রমাণ সংগ্রহ করছেন, যা আন্তর্জাতিক সালিশি আইন ও কার্যক্রম অনুযায়ী চুক্তিগুলো নতুন করে আলোচনা বা বাতিল করার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর এই তদন্ত আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী হবে এবং আন্তর্জাতিক আলোচনা ও সালিশিতে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করছেন তারা।

রিভিউ কমিটির তথ্যনুযায়ী, বিদু্যৎ খাতে বিশেষ আইনে ৭ টি বড় চুক্তির পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এগুলো হলো- আদানি (গোড্ডা) বিআইএফপিসিএল ১২৩৪.৪ মেগাওয়াট কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্র, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্র, মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল বিদু্যৎ কেন্দ্র, আশুগঞ্জে ১৯৫ মেগাওয়াট গ্যাস বিদু্যৎ কেন্দ্র, বাঁশখালী ৬১২ মেগাওয়াট কয়লা বিদু্যৎ কেন্দ্র, মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল বিদু্যৎ কেন্দ্র, মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট গ্যাস/এলএনজি বিদু্যৎ কেন্দ্র।

পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমতুলস্না বলেন, এই চুক্তিগুলো শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ আইন কিংবা টেন্ডার ছাড়া এ চুক্তি করা হয়েছে বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এসব চুক্তির কারণে দেশের জ্বালানি ও বিদু্যৎ খাতে ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যা দায় বহন করছে সাধারণ মানুষ। তাই কোন চুক্তি যদি দেশের মানুষের বোঝা হয় তা দ্রম্নত বাতিল করা দরকার।

বিদু্যৎ খাতের সাবেক এই কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, বিষয়টি যেহেতু আদালতে গেছে তাই রিভিউ কমিটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না দেওয়ার আগে কিছু বলা যাবে না। তবে এসব চুক্তি এখন বিষ ফোড়ার মতো। যতদ্রম্নত এগুলো সরানো যাবে ততই মঙ্গল। সে ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ আওয়ামী সরকার এমনভাবে চুক্তি করেছে যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রতিটি পয়েন্ট ধরে বিশ্লেষণ করতে হবে।

যেমন কোন পরিস্থিতিতে ও লক্ষ্য নিয়ে চুক্তি করা হয়েছিল। যেহেতু দ্রম্নত জ্বালানি ও বিদু্যৎ সরবরাহ আইনে করা হয়েছে, তাই চাহিদা মেটাতে বেশি দাম দিয়ে সে সময় বিদু্যৎ কিনতে হয়েছে এমন ব্যাখ্যা থাকবে। তাই দেশে ওই সময়ে বিদু্যতের চাহিদা কত ছিল এবং চুক্তির পরিকল্পনায় কোন বছরে কত চাহিদা প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল। এর বিপরীতে ওই বছরগুলোতে স্বাভাবিক বিদু্যৎ সরবরাহ কত ছিল। তাহলেই অনেক তথ্য জানা যাবে। এমন অসংখ্য টেকটিনিক্যাল পয়েন্ট রয়েছে, যার প্রতিটিকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামিট আদানিসহ বিশেষ কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সরকার অনৈতিক আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব চুক্তির বেশিভাগই বাতিলযোগ্য কারণ দেশে বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ থাকা অবস্থায় এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশের একের পর এক বিদ্যমান বিদু্যৎ কেন্দ্র বসিয়ে দিয়ে আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে সুবিধাভোগীদের চড়া দামের বিদু্যৎ ব্যবসা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে।

তবে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনই বিকল্প ভাবতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বসে থাকা অনেক বিদু্যৎ কেন্দ্র ক্রমান্বয়ে চালু করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার পরিকল্পনা করা যেতে পারে। কারণ দেশের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়াও কেউ যদি চুক্তি সংশোধন করে সে ক্ষেত্রে ক্রয় অব্যাহত রাখা যেতে পারে। দেখা গেছে আগামী ২-৪ বছের ৪-৫ হাজার মেগাওয়াট বিকল্প বিদু্যতের উৎস নিশ্চত করা গেলে এসব চুক্তির নির্ভরতা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে পারে প্রধান বিনিয়োগের খাত। যা দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিশ্চয়তা দেবে। কেবল এক বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা পেলে সৌরবিদু্যৎ খাতে ১ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব বলেও দাবি সংশ্লিষ্টদের।

বকেয়া পরিশোধ ও বিদু্যৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ

এদিকে বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে ক্রমবর্ধমান বকেয়া পরিশোধের চাপে রয়েছে বর্তমান সরকার। প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা করে পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে, তবুও বকেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলছে। যা গড়ে প্রতি মাসে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা হারে বাড়ছে। এই বিপুল অর্থ পরিশোধে বিদু্যৎ ও জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে বিকল্প খোঁজা হচ্ছে। যা এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একই সঙ্গে আমদানি বাবদ বকেয়া পরিশোধ ও বিদু্যৎ উৎপাদনে জ্বালানির যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিয়েছে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ। একদিকে দাম বাড়ালে ভোক্তার চাপ বাড়বে, অন্যদিকে রয়েছে রিজার্ভের ঘাটতি।

এরই অংশ হিসেবে এসব চুক্তি রিভিউ করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এছড়াও ঋণ সহায়তা বৃদ্ধি, বন্ড ছাড়াসহ আমদানিতে কিছু কৌশল নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। ইতোমধ্যেই বকেয়া পরিশোধের পরিমাণ বাড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। বিদু্যৎ ও জ্বালানি বিভাগের তথ্য মতে, গত সরকারের আমলে অর্থাৎ ৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট বকেয়ার পরিমাণ ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। যা গত কয়েক মাসে কমে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

কিন্তু এখাতে বড় একটি অংশই ভর্তুকি দেয় সরকার। যার প্রধান কারণ অসম বিভিন্ন চুক্তি। চলতি বাজেটে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ধরা হয়েছে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় বাজেটের এই অর্থ ছাড় নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ ছাড় হতে পারে। যা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে দেশের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে।

এদিকে, জ্বালানি সংকটে উৎপাদনে থাকা দেশের প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। যা সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত বয়েকা পরিশোধের চাপ বাড়ায় নতুন জ্বালানি আমদানিতে প্রভাব ফেলছে। ফলে বড় বড় কয়েকটি কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

বিপিডিবির তথ্য বলছে, গত অক্টোবর থেকে দেশের প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটে নেমেছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রয়েছে আরও ২৮টি কেন্দ্র। উৎপাদন নেই ৫৫টি কেন্দ্রে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে