ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

৮১ বছর পর খননে মিলেছে ২৩ জাপানি সেনার দেহাবশেষ

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কুমিলস্নার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির ২৪টি সমাধি খনন করে ২৩টিতে জাপানি সৈনিকদের কঙ্কাল, মাথার খুলি ও দেহাবশেষের আলামত মিলেছে। এগুলো এখন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে জাপানে নেওয়ার পর তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সেখানেই 'যথাযথ মর্যাদায়' সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কুমিলস্না-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুমিলস্না সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত প্রায় ছয় একর জমিতে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির অবস্থান। এখানে ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) ব্রিটিশদের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১৩টি দেশের ৭৩৮ সেনাকে সমাহিত করা হয়। এখানে খনন কাজে সম্পৃক্ত জাপানের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে থাকা মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক) বলেন, '১৩ নভেম্বর ওয়ার সিমেট্রিতে খনন কাজ শুরু হয়। যা ২৪ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে আমাদের পরিশ্রম শতভাগ সার্থক হয়েছে এটা বলতে পারি, এটা আনন্দের বিষয়। নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগেই শুক্রবার বিকালে খননকাজ শেষ হয়েছে।' তিনি বলেন, '৮১ বছর পরও সৈনিকদের কিছু কঙ্কাল, মাথার খুলি ও শরীরের বিভিন্ন অংশের বেশ কিছু হাড় আমরা পেয়েছি। প্রতিটি সমাধি কখনো যন্ত্রপাতি, কখনো হাতে সাবধানতার সঙ্গে খনন করতে হয়েছে। ২৪টি সমাধি খনন করা হলেও একজনের সমাধিতে কিছু পাওয়া যায়নি।' তিনি বলেন, 'গ্রামে যারা কবর খননের কাজে পেশাদার তাদের এনে এ কাজে সহায়তা নিয়েছি। আমরা দেহাবশেষ তুলে দিয়েছি। জাপানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি ফরেনসিক টিম সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক অন্য কাজগুলো করেছে।' তিনি আরও বলেন, 'ধারণা করা হচ্ছে, যে সমাধিতে কোনো আলামত মেলেনি ওই সৈনিকের বয়স খুব কম ছিল। ২৩ জনের সমাধিতে যতটুকু দেহাবশেষ মিলেছে আশা করা হচ্ছে, জাপানে নিয়ে গিয়ে ফরেনসিক টিম পরীক্ষাগারে একটি ইতিবাচক ফল পাবেন। তারাও এ বিষয়ে আশাবাদী।' তিনি জানান, এর আগে ১৯৬২ সালে একজন সৈনিকের দেহাবশেষ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্বজনরা। ফলে ৭৩৭ সৈনিকের দেহাবশেষ থেকে যায়। এই যুদ্ধসমাধি ক্ষেত্র তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন। কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিলেস্নাল সাত্তার বলেন, 'উত্তোলন করা দেহাবশেষগুলো জাপানে ফিরিয়ে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেবে জাপান সরকার। জাপানে নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে পরের প্রজন্মের সঙ্গে মিলিয়ে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাদের যথাযথ মর্যাদায় সামরিক কায়দায় সেখানে আবার সমাহিত করা হবে।' সমাধি খনন ও দেহাবশেষ উত্তোলনকাজে কাজে ছিলেন সাতজন জাপানি প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের একটি ফরেনসিক দল। কুমিলস্না শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে বুড়িচং উপজেলায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এই ওয়ার সিমেট্রি বা যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র। সরকারি তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে এটি একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫ হাজার সৈনিক নিহত হন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে তখনকার বার্মা, ভারতের আসাম ও বাংলাদেশে মোট নয়টি যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের দুটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল যার একটি ময়নামতি, আরেকটি চট্টগ্রামে। এর মধ্যে ময়নামতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত তখনকার ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্যদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এই সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন। এই সমাধিক্ষেত্রে মোট ৭৩৬টি কবর আছে বলে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫৭ জন যুক্তরাজ্যের। এছাড়া তখনকার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে এলাকা সেই অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ ও জাপানের ২৪ জনের সমাধিস্থল এটি। এর বাইরে যাদের সমাধি আছে তাদের মধ্যে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন করে, নিউজিল্যান্ডের চারজন, রোডেশিয়ার (বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) তিনজন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ এবং তৎকালীন বার্মা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডের আছেন একজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হলেও আসিয়ান দেশগুলোর এলাকায় বহু জাপানি সেনার সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। তিনি বলেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ও জাপানিদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। জাপানিরা সিঙ্গাপুর ও চীনের কিছু এলাকায় দখলের পর ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। জাপানিদের রেঙ্গুন দখলের পর বার্মা যুদ্ধে বহু সৈনিক মারা যায়। সেই সময় যারা আটক হয়েছিল বা আহত অবস্থায় কুমিলস্নায় নিয়ে আসা হয়েছিল, পরবর্তীতে তাদের মৃতু্য হলে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।' কেন দেহাবশেষ নিচ্ছে জাপান অধ্যাপক আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক থেকেই ওই যুদ্ধের সময় বিশ্বজুড়ে নিখোঁজ জাপানি সৈন্যদের খুঁজে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠতে থাকে। তখন প্রায় চব্বিশ লাখ জাপানি সেনা যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল এবং এর অর্ধেকই আর ফিরে যায়নি। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলেও পঞ্চাশের দশকে বিশ্বজুড়ে সমাধিস্থ হওয়া সৈনিকদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে এসে জাপান পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয় যার লক্ষ্য হলো ২০২৪ সালের মধ্যে জাপানের বাইরে থাকা জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ উদ্ধার ও জাপানে ফিরিয়ে নেয়া। তবে এর আগে যেসব পরিবারের সেনারা নিখোঁজ ছিল তাদের অনুরোধে ডিএনএ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় জাপান সরকার। ২০২৩ সালের জুলাইতে জাপান হারানো সৈন্যদের দেহাবশেষ বিষয়ক সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র চালু করে, যারা ডিএনএ পরীক্ষার দায়িত্ব পায়। এর আগে ১৯৪৩ সালে প্যাসিফিক অঞ্চলে মারাত্মক বিপর্যয়ের পর সামরিক বাহিনী নিহতদের পরিবারে শুধু পাথর ভর্তি বাক্স পাঠিয়েছিল। যার অর্থ, তাদের পরিবারের সদস্য সৈনিক মারা গেছে। তখন আর কোনে াতথ্য পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি। লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অব.) বলেন, 'জাপান কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ময়নামতি সিমেট্রি থেকে জাপানিদের দেহাবশেষ উত্তোলনের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করে।'