বিষাক্ত শিশুখাদ্যে সয়লাব বাজার

ক্যানসার-কিডনি-লিভার ও স্নায়ুরোগের আশঙ্কায় লাখ লাখ শিশু

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

এম এইচ সৈকত
শিশুদের আকৃষ্ট করতে রাস্তাঘাট, স্কুল ও গণপরিবহণে হরেক রকমের পণ্যের হকারদের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। এদের মধ্যে আবার বাহারি খাদ্যপণ্যের হকারই বেশি। ফেরিওয়ালা থেকে দোকান সব জায়গায়ই শিশুদের আকৃষ্ট করতে নানা রঙের চিপস, আঁচার, জুস, হাওয়াই, চুইনগাম, চকোলেটসহ ইত্যাদি বিষাক্ত খাদ্যপণ্য। এসব খাদ্যপণ্য দেদার বিক্রি হলেও বেশিরভাগেরই নেই কোনো মান। রঙিন মোড়কে মোড়া এসব পণ্যের নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদনও। এদিকে, এসব খাদ্যপণ্যের কারণে শিশুরা নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ অভিভাবকরাও জানেন না, তারা শিশুদের কী খাওয়াচ্ছেন। ফলে শিশুদের মধ্যে ক্যানসার, কিডনি, লিভার ও স্নায়ুরোগ দিন দিন ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। অন্যদিকে, প্রতিনিয়ত অনুমোদনহীন বিষাক্ত রাসায়নিক ও রং ব্যবহার করে শিশুদের কাছে আকর্ষণী খাদ্য তৈরি ও মোড়কজাত করে বিক্রি হলেও এসব খাদ্যপণ্য বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নেই তৎপরতা। হাজারো অভিযোগ পেলেও দিনের পর দিন কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ বিষয়টি নিয়ে কেউ পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে ওইসব ভুয়া, অস্বাস্থ্যকর, অনুমোদনহীন খাদ্যপণ্য ও কলকারখানা দিন দিন বাড়ছে। অথচ সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছেন, শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, জেল-জরিমানা ও কারখানা সিলগালা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল খাদ্যপণ্য প্রস্তুতের বেআইনি কাজ। তবে সব কিছু (সংস্থা) ম্যানেজ করেই ব্যবসা করছেন তারা। ফলে নামি ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজার সয়লাব নকল এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর শিশুখাদ্যে। পরিচিত দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের চকলেট, জুসের মতো শিশুপ্রিয় কমপক্ষে ৫০টি খাদ্য নকল করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। এসব নকল ও ভেজাল পণ্যের মোড়ক দেখে কোনটা আসল, কোনটা নকল- তা বোঝার উপায় নেই। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর চকবাজার, বাড্ডা, মিরপুর, গুলিস্তানসহ যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় শত শত বিষাক্ত শিশুখাদ্য উৎপাদনের কারখানা। এসব কারখানার বাইরেও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে উৎপাদন হচ্ছে শিশুদের খাদ্য। অথচ এসব শিশু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো অনুমোদন নেই। তারপরও এসব পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করা হচ্ছে বিপণন। আর এসব খাবার খেয়ে ক্যানসারসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতায় পড়ছে শিশুরা। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া নামমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব কারখানা। অথচ খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ড এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান থাকার পরও এসব খাদ্যপণ্যের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টদের ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও ভেজাল পণ্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশের কারণে। ফলে অভিযান চালানোর পরও এসব কারখানা চলমান থাকে। অভিযানে সিলগালা করা অনেক কারখানা অন্য স্থানে গিয়ে আরও পরিধি বৃদ্ধি করে ফের চালু করে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। অভিভাবকরা জানান, বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে বের হলেই বিষাক্ত খাদ্যপণ্যে তাদের নজর আকৃষ্ট করে। ফলে ক্ষতির আশঙ্কা জেনেও বাচ্চাদের মন রক্ষার্থে ওইসব বিষাক্ত খাদ্যপণ্য কিনে না দিয়ে পারা যায় না। এরপরও যতটুকু পাড়ি ওইসব খাবার থেকে তাদের দূরে রাখি। কিন্তু বাচ্চারা যখন স্কুলে কিংবা বেড়াতে যায় তখন আর কন্ট্রোল করা যায় না। তাই শিশুদের সুস্বাস্থ গড়ে তুলতে এসব ক্যামিকেলযুক্ত বিষাক্ত খাদ্যপণ্য পুরোপরি বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। নাসরিন সুলতানা নামে একজন অভিভাবক জানান, শিশুদের আকৃষ্ট করতে ওইসব খাদ্যপণ্য এমনভাবে মোড়কজাত ও প্যাকেটজাত করা হয়, আমরা বড়রাও অনেক সময় আকৃষ্ট হয়ে যাই। ফলে তাদের পণ্য বাজারে শিশুসহ বড়দের কাছেও সাড়া ফেলে। কারণ এসব বিষাক্ত খাদ্যপণ্যের যেমন মোড়কজাত ও প্যাকেটজাত রয়েছে তেমনি বিএসটিআইয়ের লোগো রয়েছে। ফলে বিএসটিআইয়ের লোগে আসল- নকল কিনা সেটা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ আমাদের নেই। কিন্তু যখন বাচ্চারা অসুস্থ হয় তখন ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পাড়ি বাচ্চাদের অধিকাংশ রোগ হয় এসব হরেক রকম খাদ্যপণ্যের কারণে। অথচ এসব খাবারে নকল বিএসটিআইর লোগোসহ অতিরিক্ত ক্যামিকেলযুক্ত খাদ্যপণ্য বন্ধে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে দিনের পর দিন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছেন দেশের লাখ লাখ শিশু। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহারের কারণে ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, পেট খারাপসহ বিভিন্ন বড় ধরনের রোগব্যাধি হতে পারে। এসব ক্যামিকেলযুক্ত খাবার শিশুদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। এসব ভেজাল খাবারের কারণে শিশুর পেটের পীড়া, চর্মরোগসহ গলার প্রদাহ হয়। তাছাড়া ঝুঁকি বাড়ছে শিশুর কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে পড়ার। চিকিৎসকরা এ-ও বলেছেন শিশুর ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এসব খাবারে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া জানান, অভিযানে নামলে শিশুদের পছন্দের যেসব ব্র্যান্ডের নকল পণ্য পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের ডেইরি মিল্ক, কিটক্যাট, কিন্ডার জয়, বাংলাদেশের প্রাণ ডেইরির জুস, আইস ললি, অরেঞ্জ ড্রিংকস, লিচি ড্রিংকস, মিল্ক ক্যান্ডি, ম্যাংগো ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন ধরনের জুস, চিপস ও তেঁতুলের আচার। নামি-দামি ব্র্যান্ডের এসব পণ্যের কোনটা আসল কোনটা নকল তা বোঝা খুব মুশকিল। ফলে অস্বাধু ব্যবসায়ীদের এসব খাদ্যপণ্য বাজার করতে সহজ হয়। তাই শিশুদের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সবার সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান জানান, 'ভোক্তাদের অভিযোগের বাইরেও আমরা প্রায়ই অভিযান চালিয়ে থাকি। অভিযানে বিষাক্ত খাদ্যপণ্য কিংবা কাঁচামাল পেলে জরিমানাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপরও সিন্ডেকেটের সহযোগিতায় অসাধুরা ওত পেতে থাকার কারণে অভিযান থেকে অনেক সময় পার পেয়ে যায়। মাঠে নামলে দেখা যায় এসব খাবারের কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে। এ বিষয়ে কাস্টমসকে চেক দিতেই হবে। এ ছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে, বিএসটিআই আছে- প্রত্যেকের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। ভোক্তা তো অভিযোগ পেলেই অভিযান চালায়। এককথায় সবার সমন্বয়ে খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে হবে।' পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ জানান, 'পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদনের ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। যারা করেন তা অবৈধ। ওই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের ছাড়পত্র আছে বললে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' বিএসটিআই মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম জানান, 'বিএসটিআইর অনুমোদন ছাড়া খাদ্যপণ্য উৎপাদন দন্ডনীয় অপরাধ। আর যারা বিএসটিআইর লোগো ব্যবহার করে তারা আরও বড় অপরাধী। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সমন্বয়ে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ফলে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অভিযান টিম মাঠে কাজ করে। জেল-জরিমানা করেও এদের বিষাক্ত খাদ্যপণ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুদের খাবার কিনে দেওয়ার আগে একটু খেয়াল করলেই বিএসটিআইর লোগো আসল- নকল চেনা যাবে। তাই এদের রুখতে প্রশাসনসহ সবারই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।' কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এস এম শাহাজাদ কবির বলেন, 'নামমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে অনেক এলাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠেছে। আমরা অভিযোগ পেলে এসব কারখানা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেই। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা যায় সিন্ডেকেটের সহযোগিতায় আরেক স্থানে গিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। ফলে এদের কন্ট্রোল করতে সংশ্লিষ্ট সবার কাজ করতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে বাসাবাড়িতেও এসব বিষাক্ত খাবার উৎপাদন হয়।' জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. শাহ গোলাম নবী জানান, নকল বা ভেজাল শিশুখাদ্য শিশুদের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ। শিশুদের খাওয়ানো হয় পুষ্টি বৃদ্ধি, শরীরের ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। ভেজাল খাদ্য খেলে এগুলো বিঘ্নিত হয়। এগুলো যারা দেখেন তারা কয়েকটি জায়গায় বিভক্ত। একটি হলো বিএসটিআই। অনেক সময় দেখা গেছে বিএসটিআই মান নির্ধারণ করে অনুমতি দিয়েছে। সেই মান ঠিক থাকল কি না, পর্যবেক্ষণ হয় কি না- আমরা জানতে পারি না। কিন্তু হঠাৎ করে অভিযানে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় এগুলোর মান ঠিক নেই। ফলে বিষাক্ত শিশুখাদ্যের কারণে শিশুরা ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, পেট খারাপসহ নানান রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. লুৎফন নেছা জানান, বর্তমানে দেশে বেশিরভাগ শিশুই ক্যানসার, কিডনি রোগসহ বড় বড় রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ একটা সময় এই ধরনের রোগ পরিণত বয়সে দেখা যেত। কারণ ওই সময় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকতো। বর্তমানে বিভিন্ন ফাস্টফুটসহ নানান স্বাদের খাবার বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়। ফলে ধীরে ধীরে শিশুরা রোগে আক্রান্ত হয়। অতিরিক্ত কেমিক্যালযুক্ত খাবার শুধু শিশু না বড়দেরও অনেক রোগ সৃষ্টি করে। তাই শিশুদের মেধা বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এসব বিষযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। তা না হলে শিশুরা অল্প বয়সেই কিডনি রোগ, লিভার সিরোসিসহ বড় রোগে আক্রান্ত হবে। তাই শিশুদের যত্নে অভিভাবকদেরও সজাগ থাকতে হবে।