চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত বন্দরনগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে পরীক্ষামূলকভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও মানা হচ্ছে না গতিসীমা। এক্সপ্রেসওয়ের ওপর চলছে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের প্রতিযোগিতা, যার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। একইসঙ্গে ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রায় ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে নেই প্রশাসনের নিরাপত্তাবলয়। ফলে রাত নামলেই এটি চলে যাচ্ছে অপরাধীদের দখলে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, চালকদের বেপরোয়া চলাচল ও ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সূত্রে জানা যায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে তা পরিবর্তন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটির্ যাম্প নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি নগরীর জিইসি বা টাইগার পাস মোড় থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে আগ্রাবাদ বা ফকিরহাটে নামা এবং নিমতলা বা আগ্রাবাদ থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে লালখান বাজার বা টাইগার পাসে নামা, এই অংশে ট্রেইলার চলাচল করতে না দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ৮টায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দ্রম্নতগামী একটি প্রাইভেটকার পতেঙ্গা অংশের বাঁকে ধাক্কা দিলে গাড়িটি উল্টে যায়। এতে দুইজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়ের ওপর একদল তরুণ বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালনার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। ৮ নভেম্বর মধ্যরাতে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় নিহত হন দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী মো. মোক্তার (২৮) ও মো. রুবেল হোসেন (৩৬)। তারা পেশায় ট্রাকচালক হলেও শখের বসে মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় তাদের মোটরসাইকেলের গতি ছিল ১০০ কিলোমিটারের বেশি। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাতে সুতা বেঁধে ছিনতাইয়ের ঘটনা। দেড় মাস ধরে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। মূলত চলাচলকারী মোটরসাইকেল আরোহীদের টার্গেট করেই পথে বেঁধে রাখা হচ্ছে নাইলনের সুতা। দুষ্কৃতিকারী চক্রের এই সুতার ফাঁদ গলায় আটকে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বাইকাররা। সেই সুযোগে বাইকসহ আরোহীদের মূল্যবান মালামাল লুটে নিচ্ছে চক্রটি। গত ২৬ অক্টোবর বিকাল চারটার পর এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট-আগ্রাবাদের মধ্যবর্তী অংশে সুতার ফাঁদে পড়ে গুরুতর আহত হন সুজন তঞ্চগঁ্যা নামের এক যুবক।
এছাড়া ৪ নভেম্বর রাত ২টার দিকে পুলিশের একটি টহল দল গোসাইলডাঙ্গা সাবের পস্নাজার ভবনের সামনে থেকে অস্ত্রসহ ডাকাতদলের ৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ডাকাতির উদ্দেশে দেশীয় অস্ত্রসহ জড়ো হয়েছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে রয়েছে ২১টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। অপরিকল্পিত এই বাঁকের মধ্যে বারিক বিল্ডিং, কাস্টমস, সল্টগোলা ও কাঠগড় এলাকার বাঁক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁকে চালকদের গতিসীমা না মানার মানসিকতা এবং বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা।
লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গার উদ্দেশে যাওয়া সিএনজি চালক মো. সুমন জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাঁক থাকার কারণে দুর্ঘটনার বেশি ঝুঁকি রয়েছে। আর বাঁকগুলোর মধ্যে যদি নির্ধারিত গতি অনুসারে গাড়ি চালানো না হয়, তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড ক্যামেরা লাগানোর কথা ভাবছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে যানবাহন চালালে তখন জরিমানা করা হবে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা ও অপ্রয়োজনীয় বাঁকই এর মূল কারণ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি তার নিজস্ব ডিজাইনের নয়। কারণ যে স্পিড ব্রেকার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো এমন ধরনের যে, একটি গাড়ি স্স্নো করলে পেছনের গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। আঁকাবাঁকা হওয়ার কারণে সড়কের কোনো কোনো জায়গা দেখতে সমস্যা হয়। সামনের ব্যারিয়ার দেখা যায়, কিন্তু রাস্তা নয়।'
সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক নেই। ফলে দুর্ঘটনা ঘটারও কোনো আশঙ্কা নেই। নিচের রাস্তার প্যারালালে ফ্লাইওভারটি করা। নিচের রাস্তাতে যেমন বাঁক আছে, উপরের রাস্তাতেও তেমন আছে। একটা সড়কে বাঁক রাখা হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। গাড়ি চালকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যও বাঁক রাখা হয়।'
দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার। কেউ কেউ এই গতিসীমা না মেনে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর চেষ্টা করছেন। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য এক্সপ্রেসওয়েতে স্পিড নিয়ন্ত্রণ ক্যামেরা লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত গতিসীমার বেশিতে চালালে ওই গাড়ি অটোমেটিক জরিমানার আওতায় আসবে।'
এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি নির্ধারিত অংশে ট্রেইলার ওঠা-নামা না করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।