বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

কক্সবাজারে পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে মিলছে পুরস্কার

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কক্সবাজারে পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে মিলছে পুরস্কার
কক্সবাজারে পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে মিলছে পুরস্কার

'ছোট সন্তানগুলো খাবারের জন্য কান্না করছিল। এ সময় তাদের একটু পানি দিয়ে নাস্তা আনতে যাচ্ছি বলে দুই মেয়েকে নিয়ে পস্নাস্টিক কুড়াতে বের হলাম। সৈকতের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুড়িয়ে পেলাম তিন বস্তা পস্নাস্টিক। প্রায় সাড়ে আট কেজি পস্নাস্টিক বর্জ্য নিয়ে সৈকতের সুপারশপে জমা দিয়ে নিজের পছন্দমতো চাল-তেল-ডিমসহ অনেক পণ্য নিয়ে ফিরলাম। এটা আমাদের মতো দরিদ্র পরিবারের জন্য অনেক বড় উপকার। কী যে আনন্দ! আজ সন্তানদের নিয়ে দু'বেলা পেট ভরে খাওয়া যাবে।'- কথাগুলো একনাগাড়ে বলার সময় চোখ ছলছলিয়ে উঠছিল আয়েশা বেগমের। সন্তানদের নিয়ে তিনি বসবাস করেন সাগর তীরের ঝাউবন বস্তির জরাজীর্ণ ঘরে।

'পস্নাস্টিক বর্জ্য দিন, বাজার নিন', 'এই পস্নাস্টিকেই খেয়ে ফেলবে আমাদের ভবিষ্যৎ', 'সবাই মিলে পস্নাস্টিক দূষণ রোধ করি সুন্দর দেশ গড়ি', 'পস্নাস্টিক পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিং করে পরিবেশ বাঁচাই'- এমন স্স্নোগান নিয়ে পস্নাস্টিক বিনিময় বাজার চালু হয়েছে কক্সবাজার সৈকতের সুপারশপে। সৈকতে পস্নাস্টিক দূষণ কমানোর পাশাপাশি অসহায় মানুষদের সহায়তা করতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন চার মাসের জন্য একটি সুপারশপ বসিয়েছে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে। এখানে পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে ১৯টি পণ্য থেকে পছন্দমতো পণ্য পুরস্কার হিসেবে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

গবেষকদের মতে, পস্নাস্টিক বর্জ্য শুধু পরিবেশ দূষণই করে না, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। পস্নাস্টিকের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান খাদ্য ও পানিতে মিশে তা মাইক্রো পস্নাস্টিকে পরিণত হয়ে মানুষের দেহে ঢোকে। এই মাইক্রোপস্নাস্টিক মানুষের শরীরে ক্যানসার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বন্ধ্যত্বসহ

নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে। সৈকতে ফেলা পস্নাস্টিক বর্জ্য জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে বস্নু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সোমবার সকালে দেখা যায়, সমুদ্র সৈকতে কমবেশি সবার হাতে পস্নাস্টিকের বোতল। প্রতিদিন পস্নাস্টিক পণ্য কুড়িয়ে বস্তাভর্তি করে নিয়ে এসে সুপারশপে জমা দিচ্ছেন পর্যটক থেকে শুরু করে স্থানীয়রা। 'পস্নাস্টিক বিনিময় বাজার' নামের সুপারশপে এসব পস্নাস্টিক জমা দিয়ে কেউ নিচ্ছেন টি-শার্ট, কেউ অন্য উপহার। আবার কেউবা নিত্যপণ্য বাজার নিচ্ছেন। আগে এসব পস্নাস্টিক পণ্য সৈকত থেকে কুড়িয়ে, কেউ ঘরে জমানো পস্নাস্টিক নিয়ে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতেন ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে।

জানা যায়, বাজারে এক কেজি পস্নাস্টিকের দাম ২০-৩০ টাকা হলেও সেখানে বিক্রি করা হয় ৬০-৮০ টাকায়। এতে এক কেজি পস্নাস্টিক দিয়ে এক কেজি চাল বা ৬টি ডিম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ১৯টি পণ্য থেকে নিজেরাই তাদের পছন্দের পণ্য বেছে নিচ্ছেন ক্রেতারা। পস্নাস্টিকের বিনিময়ে পণ্য কিনতে পেরে খুশি সবাই। আর এই উদ্যোগটি স্থানীয় মানুষের মধ্যে পস্নাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করা জনগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তা হিসেবে কাজ করছে।

এখানে রিকশাভর্তি করে পস্নাস্টিক নিয়ে এসেছেন আবু সুলতান। তিনি বলেন, 'পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে বাজার মিলছে এমন খবর জানতে পারার পর আমার কুড়ানো পস্নাস্টিক পণ্য নিয়ে এসে জমা দিয়েছি। প্রায় ১২ কেজি হয়েছে। তার বদলে আমি আমার পছন্দের জিনিসগুলো পেয়েছি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য অনেক ভালো একটি বিষয়, জিনিস-পাতির যে দাম! তেল, ডিম, ডাল নিলাম, অনেক টাকা বাঁচল।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী রানা আহমেদ বলেন, 'সৈকতের বিভিন্ন স্থানে পস্নাস্টিকসহ বর্জ্য ফেলার ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশের সৌন্দর্যহানি ঘটছে। এসব বর্জ্য পরিষ্কারের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া পস্নাস্টিক বর্জ্য জমা দিলেই সবার হাতে উপহার বা বাজারসামগ্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে। জনসচেতনতা ও বসবাসযোগ্য সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সবাইকে উৎসাহিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষকে সম্পৃক্ত করতেই আমরা সারাদেশে পস্নাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোর চালু করেছি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, 'একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলেছে পস্নাস্টিক। পৃথিবীকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য রাখতে হলে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগটি শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে