অনন্ত ডেনিমের শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি
প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিশেষ প্রতিনিধি
সরকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়ে থাকে রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানি করতে হয়। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা হয়। পণ্যগুলো খোলাবাজারে বিক্রি নিষেধ রয়েছে। কিন্তু অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড বিদেশে পণ্য রপ্তানি না করে খোলা বাজারে বিক্রি করেছে। বন্ডেড সুযোগের অপব্যবহার করে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে একশ' তিন কোটি ছেষট্টি হাজার টাকা। এ বিষয়ে কাস্টমস অ্যান্ড কমিশনারেট শুল্ক-করাদি ফাঁকি সংক্রান্ত মামলা প্রতিবেদন দাখিল করলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে বিষয়টি এখনো সুরাহ হয়নি বরং ধামাচাপায় পড়ে গেছে বিষয়টি। অনন্ত ডেনিম টেকনোলজির এমডি শরীফ জহির ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আবার নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে। কে এই ক্ষমতাধর শরীফ জহির? এ নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী মহল, কাস্টম কর্মকর্তাদের ও সিঅ্যান্ডএফ মালিকসহ আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের ৩০ মে'র কাস্টমস অ্যান্ড কমিশনারেট একটি নথি থেকে দেখা যায়, শরীফ জহিরের মালিকানাধীন অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেডের বিরুদ্ধে কর কমিশনারে মামলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বেশ কয়েকজন রাজস্ব কর্মকর্তা। যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সাতজন কর্মকর্তা শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করে ফাঁকির বিষয়টি উদঘাটন করেন। তদন্ত টিমে ছিলেন- ঢাকার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ঢাকার উপ কমিশনার রেজভী আহম্মেদ, রাজস্ব কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন, রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাকের আহমেদ, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মৌসুমী আক্তার এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায়।
সূত্র জানায়, সে সময় কাস্টম কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি হাতেনাতে ধরে। পরে অনন্ত ডেনিমের জেনারেল ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম চৌধুরীর কাছ থেকে লিখিত ও বিবৃতি নেওয়া হয়।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বন্ড সুবিধায় ২৩,৪১,১৩৪ কেজি ডেনিম ফেব্রিকসের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১০৮,৪৩,৩৪,৪৪৬ টাকা এবং এর ওপর প্রযোজ্য শুল্ক করাদির পরিমাণ ৯৯,৬২,৯২,০৪১ টাকা ও ২৯১১৪৭৫ কেজি ডাইস কেমিক্যালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১১১৪৩৫০১৯, যার বিপরীতে প্রযোজ্য শুল্ক করাদির পরিমাণ ৪০৬৭৪২৮৮ টাকা। মোট ১০৩,৬৯,৬৬৩২৯ টাকা (একশত তিন কোটি উনসত্তর লক্ষ ছেষট্টি হাজার) অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেডের কাছে আদায়যোগ্য, যা পুরো রাজস্বটাই সরকারকে ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অনুসন্ধানে আরও জানা
যায়, ২০২২ সালে ২ মার্চ ভারত থেকে রপ্তানি সুবিধার আওতায় আমদানি করা ডেনিম ফেব্রিক্সের ট্রাক থেকে মাদকসহ অবৈধ পণ্য উদ্ধার করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। ডেনিম ফেব্রিকসের আমদানিকারক ঢাকার অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড ও ফ্যাশন ফোরাম লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। এ ঘটনায় দুজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্স বাতিল ও বেনাপোল বন্দর থানায় মামলা করা হয়।
কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ এর সেকশন ১৩ এর সঙ্গে পঠিতব্য বন্ড লাইসেন্সের শর্ত ও একই অ্যাক্টের সেকশন ৮৬, ৯৭ ও ১১৪ এর বিধান এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী দন্ডযোগ্য এবং দন্ডিত অর্থ আদায়যোগ্য। কিন্তু প্রতিবারের মতো নানান টালবাহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে বের হয়ে যান এই শরীফ জহির।
কে এই শরীফ জহির
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউসিবিএল ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান শরীফ জহির। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের (বিজিএমইএ) সদস্য। অনন্ত গ্রম্নপের এমডি শরীফ জহিরের চট্টগ্রাম ইপিজেডে জেড অ্যান্ড জেড ইন্টিমেন্টস কারখানা রয়েছে। এছাড়া আদমজী ইপিজেডে ৫টি কারখানা রয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকসহ উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের দহরম-মহরম সম্পর্ক থাকলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ১৮০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে শরীফ জহির হয়ে গেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লোক।
আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা হাইকোর্টের (উচ্চ আদালত) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে দাখিল করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পানামা পেপারসে ৪৩ ও প্যারাডাইস পেপারসে ২৬ জনের নাম রয়েছে। সেই তালিকাতেও এই শরীফ জহিরের নাম রয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে শরীফ জহিরের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি। পরে মেইল, হোয়াটঅ্যাপ এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর দেননি।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর শুল্ক, বন্ডেড ও আইটি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'তৎকালীন সরকারের আমলে অনেকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেক কিছু ধামাচাপা দিয়েছে। এখন আর সেই সুযোগ নেই। এখন কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল; কিন্তু বিশেষ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেগুলোর বিষয়ে অচিরে আমরা পুনরায় ব্যবস্থা নিচ্ছি।' তিনি শরীফ জহিরের বিষয়ে বলেন, ঢাকার রাস্তায় বিশ্বখ্যাত রোলস রয়েস পাওয়ার পর সেটি তদন্ত করার সময় ওনার সম্পর্কে জানা যায়। মূলত গাড়িটি শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।