'১০ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধ খেয়ে আসছি। এখন কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডায়াবেটিস সকালে ৭ থাকলে বিকালে সেটা ১৮-২০ থাকে। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। কোনোভাবেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাচ্ছি না।'- কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার শিউলি আক্তার। তিনি বলেন, 'ইদানীং চোখে ঝাপসা দেখছি। হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। চিকিৎসক বলেছে, চোখে সমস্যা নেই। আস্তে আস্তে এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ডায়াবেটিসের কারণে এমন হচ্ছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন'।
বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার কালিহাতা গ্রামের গৃহিণী ফাতেমা বেগম বলেন, 'ডায়াবেটিস খুবই বেশি। হঠাৎ কমে যায় আবার কিছু ক্ষণের মধ্যে এটি বেড়ে যায়। ওষুধ খাচ্ছি কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাচ্ছি ন।'
শুধু শিউলি আক্তার কিংবা ফাতেমা বেগম নয়, তাদের মতো লাখ লাখ রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। তবে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধুমাত্র সচেতনতাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। কিভাবে শুরুতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা সবাইকে শিখিয়ে দিতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে আজ সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য 'ডায়াবেটিস : সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার'।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সমিতির অন্যান্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলা- উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের নিয়ের্ যালি, বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়, আলোচনা সভা ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য মতে, দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে এক কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিকে আক্রান্ত। এদের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ জানেই না যে, তাদের ডায়াবেটিকস আছে। বাকি ৫০ শতাংশ মধ্যে ৬৩ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত। অন্যদিকে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সিদের সংখ্যা ৩০ লাখ আর বাকিরা ৩৫ বছরের বেশি বয়সি।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. অপরূপরতন চৌধুরী বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ধুমপান করছেন এমন সব মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা অন্যদের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়েছে এখনও ধুমপান করছেন তাদের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এদের কিডনি, হার্ট, হৃদরোগ ও চোখসহ নানা অঙ্গ হারানোর ভয় বেশি।'
তিনি আরও বলেন, 'যাদের মুখের মাড়ি ও দাঁতের সমস্যা আছে। তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। তারা সেটা প্রথমেই বুঝতে পারে না। জটিল পর্যায়ে চলে গেলে তখন সমাল দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রত্যেকের উচিত অবস্থা জটিল হওয়ার আগে ৩০ বছরের পর থেকে দাঁত মাড়িসহ অন্যান্য অঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, 'সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগী আছে। গরিব দেশগুলোতে এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে। তবে কিছু কিছু উন্নত দেশ সেটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। সচেতনতাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। কিভাবে শুরুতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা সবাইকে শিখিয়ে দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'ডায়াবেটিসের টাইপ-২ ধরনের ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই আগে থেকে সতর্ক থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম করলে এবং খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।'
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যাদের বাবা-মা, ভাইবোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। এ ছাড়া যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। এমনকি যাদের হৃদরোগ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে সামনে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ৮০ শতাংশ রোগীকে রোগ নির্ণয়ের আওতায় আনা। ৮০ শতাংশ রোগীর রক্তশর্করা সুনিয়ন্ত্রণে রাখা। ৮০ শতাংশ রোগীর রক্তচাপ সুনিয়ন্ত্রণে রাখা। ৪০ শতাংশ রোগী, যাদের বয়স চলিস্নশের বেশি তাদের 'স্টাটিন' জাতীয় ওষুধ পাওয়া নিশ্চত করা ও ১০০ শতাংশ টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীর কাছে ইনসুলিন ও অন্যান্য সুবিধা পৌঁছে দেওয়া।