রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক (রুইলুই) ভ্যালি ৪৫ দিন পর মঙ্গলবার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে সকাল থেকেই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আগাম কক্ষ বুকিং। প্রথম দিনে প্রায় একশ ছোট-বড় গাড়ি পর্যটক নিয়ে সেখানে যায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন ও পর্যটনের সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সহিংস ঘটনার পর ইউপিডিএফ অবরোধ কর্মসূচি দেয়। এ সময় তিন দিন প্রায় দেড় হাজার পর্যটক সাজেকে আটকা পড়েন। পরে সাজেক থেকে ফেরার পথে অপহরণের ঘটনাও ঘটে। এমন ঘটনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের এক জরুরি সভায় ওই দিন থেকেই ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাজেক হভ্যালিতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় পর্যায়ক্রমে এ নির্দেশনার মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়।
সাজেক ভ্যালি রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সূত্র জানায় যায়, সাজেক ভ্যালি মূলত ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সাজেকে যাওয়ার রাস্তাটি খাগড়াছড়ি ওপর দিয়ে হওয়ায় পর্যটকেরা এত দিন আসতে পারেনি। আজ থেকে খাগড়াছড়ি জেলায় পর্যটকদের জন্য জারি করা নিরুৎসাহিতকরণ নির্দেশনা তুলে নেওয়ার কারণে পর্যটকেরা আবার আসতে শুরু করেছে। তবে আজ খুব বেশি পর্যটক আসছেন না। আগাম কক্ষ বুকিং চলছে। আগামী সাপ্তাহিক ছুটিতে (শুক্র ও শনিবার) বেশি বুকিং হবে বলে আশা করছেন।
সূত্রটি আরও জানায়, এখন পর্যন্ত সাজেক ভ্যালিতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আগাম কক্ষ বুকিং হয়েছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সব কক্ষ বুকিং হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বুকিং না নিয়ে যদি কেউ সাজেকে আসেন, তাহলে কক্ষ না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাজেকে হিল ভিউ রিসোর্টের মালিক ইন্দ্রজিৎ চাকমা বলেন, 'পর্যটকেরা বিভিন্ন রিসোর্ট-কটেজের কক্ষ বুকিং নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে অধিকাংশ রিসোর্ট-কটেজের কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে। আমার রিসোর্টে আগামী শুক্রবারের জন্য সব কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে।'
অন্যদিকে সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মণ বলেন, 'আমাদের সাম্পারি রিসোর্টের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার ৮০ শতাংশ ও শুক্র ও শনিবার সব কক্ষ বুকিং হয়েছে। অন্য রিসোর্টগুলো মিলে শুক্র-শনিবার প্রায় সব কক্ষ বুকিং হয়েছে। তবে মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার সাজেক সব রিসোর্টের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বুকিং হতে পারে।'
পাহাড়ের সংঘাতের কারণে রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি বন্ধ থাকার কারণে লোকসানের মুখে পড়েন অসংখ্য ব্যবসায়ী। চাকরি হারানোর শঙ্কাও তৈরি হয় কর্মচারীদের। অবশেষে সাজেক খুলে দেওয়ায় যেমন পর্যটকদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে তেমনি স্বস্তি এসেছে ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের প্রাণে। দীর্ঘদিন পর সাজেকে পর্যটক আসায় খুশি সবাই।
প্রথম দিন পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও ধীরে ধীরে পর্যটকরা সাজেকমুখী হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাজেকে ১১৬টি হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে। এছাড়া ১৪টির বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে।
সাজেক চিলেকোঠা রেস্টুরেন্টের মালিক নাছির উদ্দিন পিন্টু জানান, বাঘাইহাট এলাকায় বেলা ১১টা পর্যন্ত ৬০-৭০টি পর্যটকবাহী গাড়ি এবং বেশকিছু মোটরসাইকেল নিয়ে সাজেকে ঢুকতে দেখা গেছে।
সাজেকের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু লোকসান রিসোর্ট-কটেজ কিংবা রেস্টুরেন্ট মালিকদের হয়নি। পর্যটকদের বহনে জিপ চালক, হেলপারদের অলস সময় কাটাতে হয়েছে। সাজেকে স্থানীয় পাহাড়িরা তাদের বাগানে উৎপাদিত ফলমূল, বাঁশকোড়লসহ হাতে বানানো অনেককিছুই বিক্রি করে, তাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ফলমূল পচে গিয়েছে। তারপরও বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে এলাকায়।
এদিকে পর্যটন কেন্দ্র উন্মুক্ত করার সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা। তিনি বলেন, 'এখানকার পর্যটন খাতের সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ থাকায় এ খাতে অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। পর্যটন চালু হওয়ায় খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে।'
খাগড়াছড়ির প্রধান পর্যটন কেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কোকোনাথ ত্রিপুরা বলেন, 'আজ (মঙ্গলবার) থেকে আলুটিলায় পর্যটকেরা প্রবেশ করছে। তবে সকালে পর্যটকের চাপ কিছুটা কম থাকে। বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক পর্যটক আলুটিলা ভ্রমণ করেছেন।'
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরিন আক্তার বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কারণে সাজেক পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে প্রশাসন। এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই। খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রগুলো মঙ্গলবার থেকে উন্মুক্ত হবে ফলে পর্যটকরা খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক ভ্রমণ করতে পারবেন।'
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ১ নভেম্বর রাঙামাটি জেলায় পর্যটক আগমনের ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও সাজেকে যেতে খাগড়াছড়ি সড়কপথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে রাঙামাটির সাজেকের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আজ থেকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সাজেক ভ্যালি।