অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে সোমবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি কলেজ। বেলা ১২টার দিকে কলেজের সামনের ধানমন্ডির ২ নম্বর রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের উদ্দেশে 'ভুয়া ভুয়া' স্স্নোগান দেন। এতে কলেজের অধ্যক্ষসহ শিক্ষকরা জিম্মি হয়ে পড়েন। এদিকে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ-অবরোধের কারণে ধানমন্ডি ও সাইন্সল্যাবের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উভয় পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দিনভর চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় হাজারো মানুষকে। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। পরে বিকাল ৫টার দিকে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ থামিয়ে চলে গেলে ধীরে ধীরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সামিহা নুর অথই বলেন, 'আমাদের বর্তমান অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ আসনে বসার পর থেকেই তারা নানা অনিয়ম করে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধে বাড়তি ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী জিজ্ঞাসা করতে গেলেও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন।'
ফারিয়া তাবাসসুম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, 'সিটি কলেজ এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন ফান্ড খুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। যার প্রতিবাদ করলেই শিক্ষার্থীদের চাপ সৃষ্টি করে। কলেজ প্রশাসন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এসব টাকা হাতিয়ে নেয়। যার মূলে রয়েছেন অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ। আমরা এসব আর চাই না। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো আচরণ করবে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।'
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বলেন, 'অবৈধ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। আমরা এখন অধ্যক্ষের অফিসে বৈঠক করতে যাচ্ছি।'
প্রসঙ্গত, গত ৭ আগস্ট অধ্যক্ষ বেদর উদ্দিনের থেকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নিয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. নেয়ামুল হক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে 'অবৈধভাবে' অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন। এরপর ওইদিনই কলেজের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মোখলেছুর রহমানকে 'অবৈধভাবে' নিয়োগ দেন কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে।
শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদ দখল করতে কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. নেয়ামুল হক বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে এসে জোর করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদে বসেন। অধ্যক্ষকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার ঘটনার পর ওইদিনই সন্ধ্যায় (৭ আগস্ট) নেয়ামুল হক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে নেন। সেদিনই কলেজের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মোখলেছুর রহমানকে নিয়োগ দেন কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেই পরদিন ৮ আগস্ট জরুরি সভা করার জন্য নোটিশ জারি করেন নেয়ামুল হক।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়ে অধ্যাপক কাজী নেয়ামুল হক গত ১১ আগস্ট অধ্যক্ষ এবং ছয় শিক্ষককে অফিস আদেশ দিয়ে কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এই ছয় শিক্ষক হলেন- বাংলা বিভাগের মো. দেলোয়ার হোসেন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ফরিদা পারভীন, ভূগোলের চৈতালী হালদার, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের আহসান হাবিব রাজা ও একই বিভাগের কায়কোবাদ সরকার এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আল ফয়সাল আকতার।
অবাঞ্ছিত হওয়া ছয় শিক্ষক বলছেন, তাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা আরও জানান, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম সুমনকে শোকজ না করেই, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে মিথ্যা অভিযোগটি তদন্ত না করেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সরাসরি তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। এতে কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনে নামে।
জানা গেছে, এর আগে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এভাবেই ১৬ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়। কলেজের এসব বিষয় নিয়ে সবার মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সৈকত হাসান বলেন, 'কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম সুমন স্যারকে কোনো কারণ ছাড়াই মিথ্যা অভিযোগ করে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। এটা অন্যায়। তাই আমরা অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবি করছি।'
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি হলো- সাসপেন্ড করা শিক্ষক সুমনকে আজকের মধ্যে সসম্মানে প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা, অবৈধভাবে চেয়ার দখল করা অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করা, আজকের (সোমবার) মধ্যেই বৈধ অধ্যক্ষ বেদর উদ্দিনকে পুনর্বহাল করা, কলেজ সংস্কারের নামে শিক্ষকদের প্রতিহিংসামূলক নোংরা রাজনীতি বন্ধ করা, অভিভাবক হয়রানি বন্ধ করা এবং রেজাল্টের অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় বন্ধ করা এবং ব্যবসায়ী কোচিং সেন্টারের মতো এক্সট্রা ক্লাস বন্ধ করা।
বিকাল পৌনে ৫টায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ থামিয়ে চলে যান। এ সময় নিউ মার্কেট থানার পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর ওই সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।