শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

উপসচিব পদে কোটা বাতিল দাবিতে একাট্টা ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা

আলতাব হোসেন
  ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
উপসচিব পদে কোটা বাতিল দাবিতে একাট্টা ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা

উপসচিব পদে কোটা বাতিলের দাবিতে সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তারা বিভিন্ন অধিদপ্তরে মতবিনিময় ও মাবনবন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন। নতুন বাংলাদেশে সরকারি নিয়োগে বা নিয়োগের পর চাকরিতে কোনো প্রকার কোটা না রাখার পক্ষে ওই ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সচিবালয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় এবং বিগত সরকারকে নির্বাচনী সুবিধা দেওয়ার শর্তে একটি ক্যাডার উপসচিব পদের ৭৫ শতাংশ কোটা নিজেদের করে নেয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপসচিব পদে কোটা বাতিলের দাবিতে এককাট্টা হচ্ছেন সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডাররা। তাদের দাবি মানা না হলে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো-পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোটাবিহীন মেধাসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার। তারা অভিযোগ করেছেন, ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে পাস করিয়ে ওই ক্যাডার উপসচিবের সব পদ নিজেদের করে নেয়। এতে সিভিল প্রশাসনে মেধার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেসব দাবি করছেন, সেগুলো হলো-উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। এসএসপি পুল ১৯৭৯ পুনর্বহাল করতে হবে। সব ক্যাডারের মধ্যে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণদের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগ দিতে হবে। উপসচিব নিয়োগে সব ক্যাডারের মধ্যে একই ব্যাচভিত্তিক নিয়োগ পরীক্ষা নিতে হবে। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদকে ক্যাডার বহির্ভূত পদ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। উন্মুক্ত পরীক্ষা গ্রহণের জন্য পিএসসিকে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। উপসচিব নিয়োগ-সংক্রান্ত ১৯৮০-২০২৪ সাল পর্যন্ত জারিকৃত সব প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে। উপসচিব কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত উপসচিব নিয়োগ স্থগিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়োগের পূর্বে পুনরায় উন্মুক্ত পরীক্ষা নিতে হবে।

২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার, উপসচিব পদে বিদ্যমান কোটা বিলোপ ও সব ক্যাডারের মধ্যে সমতার বিধানসহ সিভিল সার্ভিসে সব রকম বৈষম্য বিলোপের দাবি নিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ইতোমধ্যে কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। উপদেষ্টারা সব রকম কোটা বাতিল ও বৈষম্য নিরসনের পক্ষে মত দিয়েছেন। পরিষদ ইতোমধ্যে সব ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে জেলায় জেলায় কমিটি করেছেন। দাবি আদায়ে বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে তারা উচ্চ আদালতে মামলাও করেছেন।

এ বিষয়ে গণপূর্ত ক্যাডারের জামিলুর রহমান বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে ২০ ফেব্রম্নয়ারি ২০০৮ তারিখে তা খারিজ হয়ে যায়। ফলে হাইকোটের্র রায়টি বহাল রয়ে যায়। তখন এই রায় নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে তোলপাড় শুরু হয়। রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হলে সরকার মামলাটি পুনরায় আপিল বিভাগে শুনানির অনুরোধ জানায়। প্রশাসন ক্যাডার তখন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রকম দেনদরবার শুরু করেন। প্রশাসন ক্যাডারের চাপে সরকার অন্তরালে বিভিন্ন রকমের সমঝোতার মাধ্যমে আপিল বিভাগে শুনানির ব্যবস্থা করেন। মামলার বাদীরা উলেস্নখ করেন, অন্তরালের সমঝোতার কারণে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক মাত্র ১০ মিনিটের শুনানিতে হাইকোর্টের রায়কে উল্টে দেন। এমনকি এই রায়ের বিষয়ে রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে আবেদনকারীকে কোনো রকম অবহিত না করেই তা খারিজ করে দেওয়া হয়।

২৫ ক্যাডারের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, ২০ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪-এর (৩) ধারা মোতাবেক প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত সব কর্মকর্তার জন্য সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদ তফসিলভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের আর কোনো পরীক্ষা বা এসএসপি বোডের্র সম্মুখীন হতে হবে না। অন্য সব ক্যাডারের জন্য এসব পদ অঘোষিতভাবেই বন্ধ হয়ে গেল। এ বিষয়ে প্রজাতন্ত্রে কর্মরত ২৫টি ক্যাডারের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।

তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা উমর ফারুক দেওয়ান বলেন, ১৯৮০ সালে ক্যাডার সার্ভিস চালুর সময় উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোতে সব ক্যাডার থেকে বাছাই করে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা। সরকার পিএসসির সঙ্গে পরামর্শক্রমে যোগ্য কর্মকর্তা নির্বাচনের জন্য একটি সিলেবাস প্রণয়ন করে। সিলেবাস অনুযায়ী, পরীক্ষা নিয়ে যোগ্য কর্মকর্তা বাছাইয়ের উদ্যোগও নেয় পিএসসি। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তার কারণে তা কার্যকর করা যায়নি। সিনিয়র সার্ভিস পুল পরীক্ষা ভুল করার মাধ্যমে জনপ্রশাসনের উচ্চস্তরে এসব পদে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়োগের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে কর ক্যাডারের সাজ্জাদ হোসেন ভূইয়া বলেন, ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণ-অভু্যত্থানের পর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন ক্যাডার বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনে। ফলে ৮ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৯২ তারিখে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার-বিষয়ক মতিন কমিটির সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় এবং 'সিনিয়র সার্ভিস পুল আদেশ, ১৯৭৯' পুনর্বহাল করে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের কোটার ভাগাভাগি বাতিল করেনি। এটাকে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারকে 'অন্ধকারে' রাখার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, ১৯৯২ সালে সচিবালয় ক্যাডার ও প্রশাসন ক্যাডার একীভূত হলে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার তাদের তফসিল সংশোধন করে। এ সময় তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাতিল হয়ে যাওয়া মতিন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাপ্ত উপসচিব ও যুগ্ম সচিবের পদগুলো তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারের ভাগের পদগুলো সেসব ক্যাডারের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়নি।

\হএ বিষয়ে কৃষি ক্যাডারের আরিফ হোসেন বলেন, উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার দখল করার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রম্নয়ারির (১১ তারিখে গেজেট প্রকাশিত) প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতির নীতিমালা, ১৯৯৮ জারি করে। এই প্রজ্ঞাপনে মোট উপসচিব পদের ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার এবং ২৫ শতাংশ পদ অপর ২৫টি ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ করে কোটা ব্যবস্থা চালু করে।

তিনি আরও বলেন, পদোন্নতিতে কোটা ব্যবস্থাটি সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের খাদ্য, কর ও তথ্য ক্যাডারের চারজন সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা হাইকোর্টে পৃথক রিট আবেদন দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে মহামান্য হাইকোর্ট ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ২০০২ তারিখে কোটা ব্যবস্থাটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়ে রায় দেন। হাইকোর্টের এই রায় আমলে না নিয়ে বরং রায়কে উপেক্ষা করে পূবের্র নীতিমালার ভিত্তিতে ১১ জুন ২০০২ তারিখে সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতির বিধিমালা, ২০০২ জারি করা হয়। অধিকন্তু, বিধিমালায় মোট যুগ্মসচিব পদের ৩০ শতাংশ কোটা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে