'মাঝে মাঝে যখন ডিপ্রেশনে চলে যাই, মনে হয় সুইসাইড করে ফেলি। এটা শুধু আমার নয়, আমাদের ডিগ্রির প্রায় সাড়ে তিনশ' শিক্ষার্থীরই এমন চিন্তা আসে'- নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) আর্কিটেকচার বিভাগের এক শিক্ষার্থী এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, 'এখন পর্যন্ত যে প্রশাসনই এসেছে শুধু আশ্বাস দিয়ে গেছে, কিন্তু ওই আশ্বাস পর্যন্তই। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দশ বছরে হাবিপ্রবি থেকে আর্কিটেকচার বিভাগের তিনটি ব্যাচের পড়াশোনা শেষ হয়েছে (১৪, ১৫ ও ১৬তম ব্যাচ)। এই বিভাগে ৫ বছরে ডিগ্রি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও লাগছে ৮ বছর। পাস করে বের হওয়া তিনটি ব্যাচের মধ্যে ১৪তম ব্যাচের সময় লেগেছে সাড়ে সাত বছর, ১৫ ও ১৬তম ব্যাচের আট বছরের মতো।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম ব্যাচের অন্যবিভাগ বের হয়ে গেলেও আর্কিটেকচার বিভাগের এখনো ৫ লেভেল ১ সেমিস্টার চলছে।
ওই শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, 'আমার বাবা একজন কলেজের পিয়ন, আমি ১৮ সালে এসে ভর্তি হই। নিজে টিউশনি করে, কষ্ট করে কোনোমতে নিজের পড়ালেখার খরচ এতদিন চালাচ্ছি। আমাদের ডিগ্রিটা এমনিতেও ব্যয়বহুল। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের জন্য আট বছর পড়াশোনার খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘ সেশনজটের ভয়াবহতায় মানসিক চাপ নিতে না পেরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন হাল ছেড়ে দিয়েছে।'
আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের ডিপার্টমেন্টে ৮ জন শিক্ষক। এর মধ্যে ৩ জন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। ৫ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে সাতটি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম। সামনে আরও একটা ব্যাচের ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে। ৫ জন শিক্ষক তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের প্রশ্ন- যেখানে শিক্ষক সংখ্যা কম সেখানে শিক্ষা ছুটি কেন দিতে হবে? তাদের কি সময়ের দাম নাই?
সেশনজটের কারণ জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা জানান, শুধু শিক্ষক সমস্যা না, ক্লাসরুম ও সরঞ্জাম সংকটেও পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রম। অন্যান্য ডিগ্রির থেকে তাদের টেবিল চেয়ার ল্যাব রুম সব আলাদা। তাদের ডিগ্রির দশ বছর হয়ে গেলেও এখনো পড়াশোনা প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবের জন্য আসবাবপত্র, ল্যাব টেকনিশিয়ানও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নবনির্মিত দশতলা ভবন নির্মাণ শুরুর আগে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন দশতলা বিল্ডিং হবে ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের জন্য, সেখানে তারা পর্যাপ্ত স্পেস পাবে। সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্ত আশ্বাস আশ্বাসই রয়ে গেছে। দশতলা ভবন চালু হয়েছে কিন্তু তাদের জন্য নয়। তাদেরও স্পেস দিয়েছে, তবে নামমাত্র। তার পরিবর্তে দিয়েছে পুরাতন অন্ধকারাচ্ছন্ন একাডেমিক ভবন (দুই) পুরোটা। সেখানে তাদের রুম থাকলেও ফ্যাসিলিটিজ নেই। সেগুলো দেওয়ার কথা থাকলেও বাজেট দেয়নি। কিন্তু তাদের সময় তো বসে নেই। ওয়াজেদ ভবনে তাদের যে দুটি রুম ছিল সেগুলোও ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থীর অভিযোগ- ক্যাম্পাসে সবসময় অবহেলিত ডিপার্টমেন্ট যেন আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামানের সময়কালে তারা দাবি-দাওয়া নিয়ে গেলে তাদের তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তাদের এও বলেছেন যে, বেশি কথা বললে ডিপার্টমেন্টই বন্ধ করে দেবেন।
এ বিষয়ে আর্কিটেকচার বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম নাঈম হোসেন মিথুন বলেন, 'স্থাপত্য বিভাগের ডিগ্রি পাঁচ বছরের এবং ১৯৬ ক্রেডিট। আমাদের বিভাগে ৮ জন শিক্ষক থাকলেও বর্তমানে ৩ জন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছে। আমাদের বর্তমানে ৭ টি ব্যাচ চলমান রয়েছে। ক্লাস ও ডিজাইন স্টুডিও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রায় ৩৮ জন শিক্ষক প্রয়োজন। একটা ব্যাচের ডিজিটাল স্টুডিওর জন্য দুইজন শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের রয়েছে ৫ জন শিক্ষক। তাছাড়া ক্লাসরুম ও ডিজাইন স্টুডিও টিএসসি, ওয়াজেদ ভবন এবং একাডেমিক ভবন ২ এ বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। এজন্য শিক্ষকরা চাইলেও দুটি ব্যাচের ডিজাইন স্টুডিও সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। যদি আমরা একটা ভবনে থাকতে পারতাম তবে সেশনজট অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হতো। আমরা প্রশাসনের কাছে বারবার একাডেমিক ভবন ২ সংস্কার এর জন্য বলেছি। বিগত প্রশাসনের সময় আমরা শুধুমাত্র ডিজাইন স্টুডিও করার জন্য দুটি রুমের ভেতরের দেয়াল ভেঙে রুমগুলো বড় করার আবেদন করা হয়। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামান অনুমোদন দিলেও প্রশাসনিক জটিলতায় সেটিও থমকে আছে। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে প্রশাসনের ধীর গতি তো রয়েছেই।'
ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মফিজউল ইসলাম বলেন, 'স্থাপত্য বিভাগের সেশনজটের পেছনে শিক্ষক সংকট মুখ্য কারণ। প্রশাসনের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরগতির কারণে বিগত সময় দুটি বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা যোগদান করেননি। তবে আমরা গেস্ট টিচারের মাধ্যমে তত্ত্বীয় বিষয়গুলো দ্রম্নত শেষ করার চেষ্টা করছি। ক্লাসরুম ও ডিজিটাল স্টুডিও সংকট দ্রম্নত সময়ে কেটে যাবে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-২ এর কিছু সংস্কার কাজ হয়ে গেলে এই সংকট কেটে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।