শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং কোড না মানা, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার অনভিজ্ঞতায় ঢাকা হয়ে উঠছে মরণ ফাঁদ
আলতাব হোসেন
  ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগরে 'দানা' নামের একটি ঘূর্ণিঝড় উপকূলে নতুন শঙ্কা জাগিয়েছে। ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, খরা ও অসময় বৃষ্টি যেন পিছু ছাড়ছে না। বছরের পর বছর দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে টিকে আছে, কোন কৌশলে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে, তা জানতে ও দেখতে বিশ্বের বড় বড় গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে আসছেন। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলা ও জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে বিশ্ব উদাহরণ। দুর্যোগ-যুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশের মানুষের মনের জোর ও লড়াই করার শক্তি বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্ব উদাহরণ হলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে আছে। যানজট, জলাবদ্ধতা, সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প আর অগ্নিকান্ডে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। বিশ্বে অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা শহরকে। ভূমিকম্পসহ নগরকেন্দ্রিক বহু ঝুঁকির ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তুতি নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং কোড না মানা, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের অনভিজ্ঞতায় ঢাকা হয়ে ওঠছে মরণ ফাঁদ। দুর্বল ও ভঙ্গুর পদ্ধতির গ্যাস, বিদু্যৎ ও পানির লাইন নগর-দুর্যোগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনতে না পারলে দুর্যোগ-পরবর্তীকালে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজও চালানো সম্ভব হবে না। তাই এবার নজর দিতে হবে নগরে।

বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। যা এখন দৃশ্যমান। জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্টতই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। প্রতিনিয়ত লবণ পানি, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন বাংলাদেশের মানুষ। ৭০-এর পর দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। এখন সরকার দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এতে যে কোনো দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. হাসিনুর রহমান বলেন, ঢাকায় জলাশয় ভড়াট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবছর ১ থেকে দেড় লাখ ভবন তৈরি হচ্ছে। কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এতে ঢাকা শহর ঝুঁকির মুখে পড়ছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে ১৫-২০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। অনেক সময় রাস্তার অভাবে অগ্নিকান্ড স্থানে পৌঁছতে পারে না ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।

জলবায়ু ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, সম্প্রতি নগরে কিছু দিন পরপরই ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাস ব্যবস্থা নেই।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, সেটা হতে পারে যে কোনো সময়। কিন্তু ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবিলার প্রস্তুতিতে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বহু পুরনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা-ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট রয়েছে। নগরায়ণের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রস্ততি নিতে হবে এখনই।

প্রকৌশলী ড. সমসের আলী বলেন, শহরে আগুন, ওয়াটার লগিং, আরবান ফ্লাড, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, ভূমিধস, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ থেকে শুরু করে শহরে আমাদের অনেক দুর্যোগ রয়েছে। এগুলোকে আমাদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয়। আমাদের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট আছে। আরবান ও রিজিওনাল পস্ন্যানিং অ্যাক্ট করাটা আমাদের আটকে আছে। ন্যাশনাল আরবান সেক্টর পলিসি ২০১৪ নামে আমাদের একটি খসড়া প্রস্তুত করা আছে, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। রাজধানী ঢাকায় বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানলে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভূমিকম্পসহ শহরের অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আলী উসমান জাবেদ বলেন, আমাদের নগরায়ণ বা শিল্পায়ন হচ্ছে অপরিকল্পিত। কোনো রকম বিল্ডিং কোড মানা ছাড়াই ভবন নির্মিত হচ্ছে। ফলে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে। মালিক নিজের মতো করে রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পর্যন্ত ঢুকতে পারছে না। গবেষণায় এসেছে, যদি স্বাভাবিক ভূমিকম্প হয়, এতে শুধু ঢাকা শহরেই তিন লাখ ৮৬ হাজার ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ ছাড়াও শিল্প-প্রতিষ্ঠানে, বস্তিতে, গ্যাস সরবরাহ লাইনে, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ও মার্কেটে সবচেয়ে বেশি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার সবগুলো নগরে অবস্থিত। আবাসিক ভবনে, বহুতল ভবন, শপিং মল, পোশাক শিল্প কারখানা, গ্যাস লাইন ও বস্তিতে বেশিসংখ্যক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নগরবাসী। ঢাকা শহরের জন্য একেবারে শুরু থেকেই পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের যে ব্যবস্থা চালু আছে, তা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভূমিকম্পের ফলে পাইপলাইন ফেটে গিয়ে অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা শুধু যে জানমালের ক্ষতি করবে, তাই নয়, ঘটাবে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। সেভাবে দেখলে এই গ্যাস পাইপলাইনগুলো আমাদের নগরগুলোর নিচে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। অথচ ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই।

পরিকল্পনাবিদ ড. আক্রাম হোসেন বলেন, নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হলে দ্রম্নত নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে। এই নীতিমালা চূড়ান্ত না হলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ থামানো যাবে না। ঝুঁকিমুক্ত নগর গড়তে জাতীয় নগর নীতিমালা প্রয়োজন। আইন বাস্তবায়নের জন্য সমন্বয়ও দরকার। কে কোন দায়িত্ব পালন করবে, সেটা চূড়ান্ত করতে হবে। যার যে দায়িত্ব, সেটা পালন করেছে কিনা, সেটাও দেখতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রকৌশলী ড. সামসুল হুদা বলেন, বন্যা ও সাইক্লোন মোকাবিলায় অনেক এগিয়ে গেলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে এখনো। পুরোপরি সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি দেশ। ঢাকা শহরের সুউচ্চ ভবনগুলো কতটা নিরাপদ, তা কেউ জানে না। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে হাঁটু পানি জমে। নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টাই নয়, পুরান ঢাকার অলি-গলিতে কেমিক্যাল থেকে লাগা অসংখ্য অগ্নিকান্ডে পুড়েছে শত শত প্রাণ। রানা পস্নাজা ট্র্যাজেডি, বসুন্ধরা, তাজরীন গার্মেন্টের আগুন, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, ডিএনসিসি মার্কেট, কাচ্চি ভাই বিরানী, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগে অসহায়ত্বের চিত্র। ঢাকায় বিল্ডিং মেনে ভবন তৈরি করছেন না কেউ। অপরিবর্তিত প্রদ্ধতির গ্যাস লাইন, ঝুলন্ত তারে বিদু্যৎ সংযোগ, ওয়াসার অপরিকল্পিত পানির লাইন ও সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা নগরের দুর্যোগ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অবহেলায় মৃতু্য আর ক্ষতির খতিয়ান দীর্ঘ হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে