শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১
গবেষণা প্রতিবেদন

কর্ণফুলী দূষণে দায়ী ৮৯ উৎস

পলিথিনের স্তর বর্তমানে ৭ মিটারেরও বেশি, উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে প্রভাব পড়ছে নদীর বাস্তুতন্ত্রে, প্রায় ৩০ প্রজাতির মৎস্যসম্পদ বিলুপ্তির শঙ্কায় ষ দিন দিন বাড়ছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াও
খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
  ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
কর্ণফুলী দূষণে দায়ী ৮৯ উৎস

কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত প্রায় ৮৯টি উৎস দায়ী বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে শিল্পকারখানা, নৌযান মেরামতের জায়গাসহ বাজার নালা, খামার, শুঁটকি পলস্নীর জন্য নদীকেন্দ্রিক স্থাপনা গড়ে ওঠা উলেস্নখযোগ্য উৎস। অপরিকল্পিত এসব কার্যক্রমের ফলে নদীতে বাড়ছে পস্নাস্টিক-পলিথিনসহ নানা বর্জ্য। এতে প্রভাব পড়ছে নদীর বাস্তুতন্ত্রে। পাশাপাশি বিলুপ্তির মুখে প্রায় ৩০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। এ ছাড়া দিন দিন বাড়ছে মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়াও।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলীর হারানো যৌবন ফেরাতে হলে দ্রম্নত প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে উজানের মানুষের পরিবেশবান্ধব টেকসই জীবন এবং জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের আগে শাহ আমানত সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারায় প্রস্থ ছিল ৮৬৬ মিটার। কিন্তু নদী ভরাট করে গড়ে তোলা বিভিন্ন প্রকার বাজার ও অবৈধ দখলের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় প্রবহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। বর্তমানে তা কমে ৪৫০ মিটারেরও নিচে এসে পৌঁছেছে। কর্ণফুলী দূষণের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয়- নদীতে চলাচলরত পাঁচ হাজারের অধিক নৌযান, নদীর দুধারে গড়ে ওঠা তিনশোর অধিক কলকারখানা ও নগরের ৩৬টি খাল দিয়ে আসা দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার টনের অধিক গৃহস্থালির বর্জ্য। তাছাড়া ভাটার ফলে আসা বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য তো আছেই। কারখানাগুলো পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার কথা থাকলেও অনুমোদন নেই অনেকগুলোরই। ফলে তারা ইটিপি ব্যবহার ছাড়াই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। যদিও মাঝেমধ্যে এদের জরিমানা করা হচ্ছে কিন্তু কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি গবেষণায় উঠে এসেছে- দেশের উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পস্নাস্টিক জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। পলিথিনের স্তর বর্তমানে ৭ মিটারেরও বেশি। এতো উঁচু পলিথিনের আস্তরণের জন্য বাধ্য হয়ে ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয় প্রায় সময়ই। এসব জিনিসের প্রভাবে নদী যে শুধু তার নাব্য হারাচ্ছে তা নয়, উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে প্রভাব পড়ছে নদীর বাস্তুতন্ত্রেও। ফলে কমছে নদীতে মাছের পরিমাণ। প্রায় ৩০ প্রজাতির মতো অর্থকরী মাছ রয়েছে বিলুপ্তির শঙ্কায়। ১৯৮৬-৮৭ সালের একটি গবেষণায় নদীতে ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও বর্তমানে কালুরঘাটের কাছে পোয়া আর ফাইশ্যা ছাড়া আর কোনো মাছই পাওয়া যায় না। পাওয়া যাচ্ছে না নদীতে আগের মতো ডলফিনের বিচরণ।

ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেনিয়ন (ইকো) পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে- বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত প্রায় ৮৯টি উৎস কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য দায়ী। উৎসগুলোর মধ্যে ৫৩টি শিল্পকারখানা, ১৪টি নৌযান মেরামতের জায়গাসহ বাজার নালা, খামার, শুঁটকি পলস্নীও অন্তর্ভুক্ত। এর অধিকাংশ উৎসই সাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত জায়গায় অবস্থিত। এই দূষণের ৩০টি কারণ শনাক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল- নগরীর কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য। অন্তর্ভুক্ত করা হয় রং ও সিমেন্ট কারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য এবং নির্মাণাধীন এলাকা থেকে বালি ও অন্য উপাদান। গবেষণা চলাকালে শিকলবাহা চ্যানেলে ৩৭, বোয়ালখালী চ্যানেলে ২০ এবং অন্য স্থানে ৭টিসহ ৬৪টি ডলফিনের দেখা মিলেছিল। কিন্তু মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর স্বাভাবিক নাব্য না থাকায় ডলফিনসহ অন্য জলজ প্রাণীদের উপস্থিতি নগণ্য ছিল। তাছাড়া এ গবেষণায় নদীর দুপাশে শনাক্ত হয়েছিল ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ। যা ৩৭৩টি গণভুক্ত এবং ১১৩টি পরিবারের অন্তর্গত। শনাক্ত হয়েছে ৩৫৫টি ঔষধি গাছ। যার মধ্যে ৮১টি বিপন্ন প্রজাতি।

চবির মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অহিদুল আলমের গবেষণায় উঠে এসেছে- নদীতে পড়া বর্জ্য এবং জাহাজ থেকে নিঃসরিত তেলের কারণে কর্ণফুলীর পানিতে বিব্রিও নামক ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, সালমোনেল ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ইকোলাই, স্ট্রেপটোকক্ষাই, স্টেফাইলোকক্ষাইয়ের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াও দিন দিন বেড়ে চলেছে। ফলস্বরূপ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া, টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগ থেকে বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগে।

১৯৫৭ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় শুরু করা হয় একটি বৃহৎ বাঁধ বানানোর কাজ। উদ্দেশ্য ছিল বিদু্যৎ উৎপাদন। দেশের একমাত্র পানি বিদু্যৎ উৎপাদন কেন্দ্র এই কাপ্তাই হ্রদের তীরে অবস্থিত। এর ফলস্বরূপ ৮৫০ একর জায়গায় এই গ্র্যাভিটি টাইপ কংক্রিটের বাঁধটি নির্মাণের ফলে কর্ণফুলী নদীর প্রাকৃতিকভাবে পানি চলাচল ব্যাহত হয়। পস্নাবিত হয় একটি বৃহৎ অঞ্চল। যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ৪

দেশের সর্ববৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ। এখানে অতিরিক্ত পলি জমার ফলে একটু পানি কমে গেলেই দেখা যায় ডুবোচর। অন্যদিকে লবণাক্ততার মতো সমস্যাও পরিলক্ষিত হয় মাঝেমধ্যে। পক্ষান্তরে যখন অতিবৃষ্টি হয় তখন আবার পস্নাবিত হয়ে যায় বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল, দেখা দেয় কৃত্রিম বন্যা।

কর্ণফুলী নদীর সার্বিক অবস্থা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শ্যামল কর্মকার বলেন, 'চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল, এর উত্তর-পূর্বদিক পস্নাবনভূমি। যেখানে হালদা নদী কর্ণফুলীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহণের জন্য যেমন নদীর ওপর নির্ভরশীল, তেমনি তাদের বর্জ্য পরিশোধনের জন্যও নদীকে ব্যবহার করছে। আমাদের একটি প্রচলিত ধারণা হলো নদীতে যা কিছুই ফেলা হোক, তা পরিশোধিত হয়ে যায়। এই মারাত্মক ভুল ধারণাকে পুঁজি করেই মানুষ দিনের পর দিন নদীদূষণ করে যাচ্ছে এবং এর প্রতিকারও দাবি করছে না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এর তথ্যগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না বিধায় এ সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না।'

কাপ্তাই বাঁধসহ নদীর ওপর নির্মিত স্থাপত্যগুলোর প্রভাব সম্পর্কে ড. শ্যামল জানান, 'ড্যাম ও স্পিলওয়ে নদীর প্রবাহ ও পলির পরিবহণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে- যা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নদীর ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রভাবিত করেছে। এসব অবকাঠামো নদীর নাব্য এবং প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। যা দীর্ঘমেয়াদে বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ কারণে বরকল ও হরিণা অর্থাৎ কর্ণফুলীর উজানে এক সময় ডলফিনের অবাধ বিচরণ দেখা গেলেও বর্তমানে তা বিলুপ্ত। তাছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে নদীর কচ্ছপের সংখ্যা দিন দিন উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাসের কথা।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীকে তার আগের যৌবন ফিরিয়ে দিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলেন, 'নদীর উজানে প্রতিবছর প্রচুর পলি জমে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেশি। কাপ্তাই বাঁধের অর্ধশতকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখন এর ভালো-মন্দ নির্ণয় করতে বসলে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পালস্নাটাই বেশি হবে। তাই নদীকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে এখনই প্রশাসনিক উদ্যোগের সঙ্গে উজানের মানুষের পরিবেশবান্ধব টেকসই জীবন এবং জীবিকা নিশ্চিত করা জরুরি। পাহাড়ে ইট-কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মাণে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ক্ষতি নিরূপণপূর্বক পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। সর্বোপরি নদীর পলি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি এবং নদীর বাস্তুসংস্থান পুনঃরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাই সময়ের মূল দাবি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে