কপ-২৯ সম্মেলন
আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বাড়াতে গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ
বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান থাকবে :পরিবেশ উপদেষ্টা
প্রকাশ | ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
আগামী নভেম্বর মাসে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন 'কনফারেন্স অব পার্টিজ' বা কপ-২৯ সম্মেলন। এই সম্মেলন সামনে রেখে বিশ্বের জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন দেশ ও পরিবেশবিদরা তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবারের সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া তরুণদের অংশগ্রহণ অভিযোজনসহ সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার থাকবে।
রোববার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো ন্যায়সঙ্গত হতে হবে এবং সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংকট মোকাবিলায় ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোর অর্থ সাহায্য কিছু আর্থিক সমস্যার সমাধান করলেও প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার হবে না।'
ঢাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত 'রোড টু বাকু :কপ-২৯ বাংলাদেশে সিএসওগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অবস্থান' শীর্ষক সেমিনারে তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে।'
এ ছাড়া তিনি অভিযোজন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তরুণদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং উচ্চাভিলাষী প্রশমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার কথা উলেস্নখ করেন। কপ-২৯ সম্মেলনের আগে, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের শেষে কপ-২৯ সম্মেলনে জোরালো অ্যাডভোকেসির আহ্বান জানানো হয়, যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। উপস্থিত প্রতিনিধিরা আশা প্রকাশ করেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সহনশীলতা গঠনে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
'কনফারেন্স অব পার্টিজ' সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে আসছে। উন্নত দেশগুলো এতদিন ধরে এ বিষয়ে টালবাহানা করলেও ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য শেষ পর্যন্ত অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দেয়। তবে তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করে আসছে ধনী দেশগুলো। ২০০৯ সালে উন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রম্নতি রক্ষায় তারা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত তহবিল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ২০২২ সালে মিশরের শার্ম এল-শেখ-এ অনুষ্ঠিত কপ-২৭ শীর্ষ সম্মেলনে একটি চুক্তি হয়। আর এটিই হচ্ছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল। এছাড়া গত বছর আমিরাতে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিভিন্ন সূত্র মতে, এ পর্যন্ত তহবিলে ১০০ মিলিয়নের বেশি জমা পড়েনি। তবে এই দুই চুক্তিকে জলবায়ু সম্মেলনের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'কপ-২৮:অভিজ্ঞতা, ফলাফল ও ভবিষ্যৎ করণীয়' শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, পাহাড়, বন, নদীর মতো বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। অকারণে ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে বিপর্যয় ডেকে আনছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের পাশাপাশি নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ক্ষতিপূরণ আদায়সহ কপ-২৯ সম্মেলনে ভালো করতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিযোজনের (দুর্যোগ আসার আগের প্রস্তুতি) সঙ্গে সমঝোতা করা যাবে না। আগামী কপ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ করতে হলে অভিযোজন, সক্ষমতা, প্রযুক্তি, ক্ষতিপূরণ, পর্যবেক্ষণের মতো আটটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শত বছরের জন্য প্রস্তুতি নিলেও বাংলাদেশের তা নেই বলেও মনে করেন আইনুন নিশাত। তিনি বৈঠকে বলেন, 'এ বিষয়ে নাগরিক সমাজকে আরও পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বাড়াতে হবে। আগামী নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ অনুষ্ঠিত হবে। তার আগেই কপ-২৯ সম্মেলনের অ্যাজেন্ডা বা আলোচ্যসূচি বেরিয়ে আসবে। অ্যাজেন্ডা ধরে প্রস্তুতি নিতে পারলে তা বাংলাদেশের জন্য কাজে আসবে।'
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের বিকল্প নেই বলে মনে করেন অক্সফাম ইন বাংলাদেশের ক্লাইমেট জাস্টিস অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস রাইটস বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ ইমরান হাসান। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করছে। এর ফলে যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে।
বেসরকারি সংস্থা জার্মানওয়াচের ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ায় ৫১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০৭০ সালের মধ্যে, এই সংখ্যাটি ৯৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত অন্য একটি সমীক্ষা অনুমান করেছে যে, ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের সঙ্গে, ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০৩৭ সালের মধ্যে ২.০৯ শতাংশ এবং ২০৬৭ সালের মধ্যে ৫.৫৩ শতাংশ হ্রাস পাবে।
দক্ষিণ এশিয়া ইতিমধ্যেই চরম আবহাওয়ার ঘটনার জন্য ব্যাপক আর্থিক ব্যয়ভারের সম্মুখীন হচ্ছে। জার্মানওয়াচের সমীক্ষা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যদিও ক্রমবর্ধমান পরিশীলিত আবহাওয়া সতর্কতার কারণে প্রাণ হারানোর সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, তবুও প্রতিটি ঝড়ের সঙ্গে ঘরবাড়ি এবং জীবিকার উৎসগুলো সবসময়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সুপার সাইক্লোন আম্ফান ২০২০ সালে ভারত ও বাংলাদেশে আঘাত হানে, এর ফলে আনুমানিক ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয় এবং ভারতে ২.৪ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশে ২.৫ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচু্যত হতে হয়।
এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের পানির উপরিভাগের উষ্ণায়নের ফলে প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে।
\হ