বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুরে ফের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শ্রমিকরা। শনিবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সারাবো এলাকায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে ও জেলার কালীগঞ্জে রিফাত গার্মেন্টেসের (মসলিন কটন মিলস লিমিটেড) সাবেক শ্রমিকরা সন্তানসহ কারখানার গেটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সড়কের উভয় পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে বেকায়দায় পড়েন যাত্রীরা। পরে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনী বেতন আদায় করে দেওয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ তুলে নেন। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলমের বরাতে গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সারাবো এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা। শনিবার সকাল ৮টা থেকে তারা বিক্ষোভ শুরু করে চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করেন। এতে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও চালকরা।
আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি মাসে তাদের বেতন দিতে হয় ৮০ থেকে ৮২ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর মাসেও বেশ কয়েকদিন আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ করে বেতন আদায় করেন
তারা। চলতি মাসেও একই অবস্থা শুরু হলে তারা কয়েকদিন আগে বিক্ষোভ করেন। পরে গত সপ্তাহে ২৭ কোটি টাকা বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকে বেতন পাননি।
এদিকে সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা বেতন আদায় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিক জাকির হোসেন বলেন, 'মাসের ১৯-২০ দিন চলে গেলেও বেতন পাচ্ছি না। বেতন না পাওয়ায় ঘর ভাড়া, দোকানের বাকি সেগুলি পরিশোধ করতে পারছি না। গত মাসেও আন্দোলন করে বেতন নিতে হয়েছে। প্রতি মাসে এই অবস্থা হলে আমাদের সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যাবে।'
প্রায় এক যুগ ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কাজ করা শরিফুল ইসলাম বলেন, 'পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের কথা দিয়েছে তারা বেতন আদায় করে দিবেন। পরে আমরা সড়ক অবরোধ ছেড়ে দিয়েছি।'
এদিকে সড়ক অবরোধে দুর্ভোগে পড়েন চন্দ্রা-নবীনগর সড়কে চলাচলকারীরা। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, 'অল্প কিছুতেই সড়ক অবরোধ করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে। শ্রমিকদের সমস্যা তারা কারখানায় গিয়ে আন্দোলন করুক রাস্তায় কেন আসে?'
বাসচালক রহিম সরকার বলেন, 'শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে সড়কে গাড়ি নিয়ে বের হতেই এখন ভয় করে। ভাঙচুর না হলেও দীর্ঘ সময় বসে থেকে সময়ও নষ্ট হয়, যাত্রীদের কষ্ট হয়, আবার তেল ফুরাচ্ছে।'
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, 'ওই কারখানায় ২৭ কোটি টাকার মতো বেতন দেওয়া হয়েছে। বেতনের বাকি টাকাও দ্রম্নত পরিশোধ করার জন্য তাদের বলা হয়েছে।'
কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, কালীগঞ্জের রিফাত গার্মেন্টেসের (সাবেক মসলিন কটন মিলস লিমিটেড) শ্রমিকরা পাওনা টাকা আদায়ে সন্তানসহ কারখানার গেটে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। মসলিন কটন মিলস লি. শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে শ্রমিকরা এই কর্মসূচি পালন করেন।
প্রধান উপদেষ্টা এবং পাট ও বস্ত্র উপদেষ্টাসহ স্থানীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীরা বলেন, 'মসলিন কটন মিলে শ্রমিকরা ১৯৫৩ সালে সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে আমাদের পরিশ্রমের টাকায় জমি ক্রয়সহ আমরা শ্রমিক/কর্মচারীরা শ্রমিক কলেজ প্রতিষ্ঠিত করি এবং ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমাদের চাঁদার টাকায় উক্ত কলেজটি পরিচালনা শুরু করে। ১৯৮২ সালে মিলটি প্রাইভেট লি. হয় এবং এতে ভূঁইয়া গ্রম্নপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ মালিকানা ছিল ৫১% এবং সরকারের মালিকানা ছিল ৪৯%। মিলটি চলমান অবস্থায় ১৯৯৩ সালে কর্মচারী/শ্রমিকদের ঈদের ছুটি দেয়। পরবর্তীতে কাঁচামালের অভাব দেখিয়ে শ্রমিক/কর্মচারীদের ছুটি বর্ধিত করতে থাকে। এতে মালিক বা সরকারপক্ষ শ্রমিক/কর্মচারীদের কোনো নোটিশ প্রদান করেনি। আমাদের নিয়োগ প্রাপ্তির তারিখ থেকে সার্ভিস বেনিফিট প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ মিলটি চালু অবস্থায় বকেয়া ৭ মাসের বেতনসহ এখানো আমাদের চাকরি শ্রম আইন অনুসারে বহাল আছে।'
তারা আরো বলেন, '৪ হাজার কোটি টাকার মসলিন কটন মিলস লি. ১৩৫ কোটি টাকায় কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে আমরা তার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। বর্তমান রিফাত গার্মেন্টেসের অবৈধ চুক্তির মেয়াদ বাতিল হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। সরকারের রাজস্ব ও কর ফাঁকি দিচ্ছে গার্মেন্টেসটির বর্তমান মালিক।'
তারা জানান, চুক্তিনামার ৫ ও ৬নং পাতায় ২য় ও ৩য় কলামে পর্যালোচনা করে দেখলে ৫১% মালিকানা আদালতকৃত উলেস্নখ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই টাকা কার কাছে দিয়েছে তার প্রমাণ দিতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে ৭১৯ জনের ছবি সংযুক্ত তালিকাসহ তথ্য জমা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও শ্রমিকদের রেশন কার্ড, হাজিরা কার্ড, অনেকের নিয়োগপত্রের উলেস্নখযোগ্য প্রমাণপত্র আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। শ্রমিক কর্মচারীদের সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ ২০০ কোটি টাকার ওপরে বকেয়া পাওনা।'
অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ওই মিলটির সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীদের সন্তানরা বলেন, অভিভাবকদের বকেয়া পাওনা টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকবে।