শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

ক্রমেই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাস হয়ে উঠছে অক্টোবর

২৪ থেকে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় 'ডানা'
বীরেন মুখার্জী
  ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ক্রমেই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাস হয়ে উঠছে অক্টোবর

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অক্টোবর ক্রমেই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাস হয়ে উঠেছে। তথ্য বলছে, ১৮৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৫৯টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে ৮টি। বাকিগুলো মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আছড়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে 'ডানা' নামে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলতি মাসের শেষ দিকে এটি তৈরি হতে পারে এবং ২৪ থেকে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশ্লেষকরা।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ সোম বা মঙ্গলবারের দিকে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পরে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এটি ভারতের উড়িষ্যা বা পশ্চিমবঙ্গের দিকে আঘাত হানতে পারে। তবে গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশেও আঘাত হানার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়টির নাম হতে পারে 'ডানা'।

এর আগে গত বুধবার থেকেই সাগরে একটি লঘুচাপ নিম্নচাপে পরিণত হয়। সেটি ভারতের তামিলনাড়ু উপকূলে বেশি প্রভাব ফেলে বৃহস্পতিবার বিদায় নেয়। এর প্রভাবে দেশজুড়ে হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ঝরে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের বরাত দিয়ে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ শুক্রবার বলেন, '২১ থেকে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি কম কিংবা মাঝারি শক্তিসম্পন্ন হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে তা ২৪ বা ২৫ অক্টোবর উপকূলে আঘাত করতে পারে। তবে স্থান-কাল নির্দিষ্ট করে বলতে হলে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'ইউরোপিয়ান আবহাওয়া মডেলের দেওয়া পূর্বাভাস অনুসারে ঘূর্ণিঝড় গঠনের ৭০-৮০% আশঙ্কাকে নির্দেশ করে। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান আবহাওয়ার অফিসগুলো করা পূর্বাভাস অধিকাংশ সময়ই সত্য হয়।'

এছাড়া ভারতের আবহাওয়াবিষয়ক সরকারি সংস্থা আইএমডি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগামী ২০ অক্টোবরের দিকে উত্তর আন্দামান সাগরে একটি ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রভাবে ২২ অক্টোবরের দিকে মধ্য বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে অতিতীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ৪৩টি। যার অধিকাংশই বাংলাদেশে আঘাত করেছে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সাগরে এক মাসে অন্তত তিনটি নিম্নচাপ তৈরি হলে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। সে অনুযায়ী এই মাসে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবল সম্ভাবনা আছে। তবে এটি বাংলাদেশের মাটিতে আঘাত করবে কি না তা এখনো বলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে ১৬টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। এই সময় অতিতীব্র ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও ১৬টি। তবে যদি অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসের ঝড়ের হিসাব করা যায় তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ১৯৭১-২০২৩ সাল পর্যন্ত এই তিন মাসে ৩৮টি ঘূর্ণিঝড় ও ৬৮টি অতিতীব্র ঘূর্ণিঝড় সাগরে তৈরি হয়েছে। এসব ঝড়ের কারণে দেশের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে।

শুধু ঘূর্ণিঝড়ই নয় অক্টোবরে তাপমাত্রা ও বৃষ্টির হিসাবেও পরিবর্তন এসেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করছেন। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক জানান, অক্টোবর মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হার ১৬০ দশমিক ৩ মি.মি.। এবার মাসে ৭-৮ দিনের বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে গড় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হারের চেয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হতে পারে। এছাড়াও অক্টোবর মাসের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিন যত যাবে ততই তাপমাত্রা কমতে থাকবে।

এই আবহাওয়াবিদ মনে করেন, এই মাসের শেষের দিকে প্রান্তিক পর্যায় অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে শীতের অনুভূতি পাওয়া যাবে। আবহাওয়ার ভাষায় সেটিকে শীত বলা না গেলেও প্রকৃত শীতের আগমনী বার্তা আসবে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে।

এদিকে, শুক্রবার সকালের আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে ঢাকায় বৃষ্টি ঝরেছে। এছাড়া খুলনা ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও বরিশালের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আজ শনিবারও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, 'এরপর ২-৩ দিন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপর লঘুচাপের প্রভাবে আবারও বৃষ্টি হতে পারে।'

অন্যদিকে অক্টোবর মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগেই বলা হয়েছে, এবার অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ধীরে ধীরে বিদায় নেবে। সেই সঙ্গে এই মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে তিনটি লঘুচাপ তৈরি হতে পারে, যার মধ্যে একটি নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। সবশেষ গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' বাংলাদেশ উপকূল ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে।

আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের দেওয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হয়। মে মাসে রেমালের পর আরব সাগরে আগস্টে ঘূর্ণিঝড় 'আসনা' সৃষ্টি হয়। 'রেমাল' নামটি প্রস্তাব করে ওমান। আর 'আসনা' ছিল পাকিস্তানের দেওয়া নাম।

এবার তালিকায় রয়েছে কাতারের দেওয়া নাম 'ডানা'। এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় রূপ নিলে এর নাম হবে 'ডানা'। তারপর গতিপ্রকৃতি দেখে কখন কোথায় আঘাত হানতে পারে- সে পূর্বাভাস দেবে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় মিগযাউম, যা পরে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। সে ঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে