মৌসুমি বায়ুর অক্ষ বিদায় নিয়েছে। দিনে গরম, রাতে শীতল হাওয়া বলে দিচ্ছে শীত আর দূরে নেই। সপ্তাহখানেক বাদেই বাতাস বইতে পারে উত্তর দিক থেকে। এ বাতাসই হিমালয় পাড়ি দিয়ে শীত নিয়ে আসবে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ বাংলা মাস কার্তিকের প্রথম দিন। এই মাস অগ্রহায়ণের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি। শিশিরের মতো নীরবে আবির্ভাব। ষড়ঋতুর দেশে নবান্নের সুবার্তা নিয়ে আসে কার্তিক মাস। ফসলের ক্ষেতে সোনারঙ্গা হাসির আভা ছড়িয়ে দেয়। এই মাসেই শীতের আবাহন জাগে। সকালে সবুজ ঘাসের ডগায় দেখা মেলে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা। সাধারণত বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যে কার্তিক মাসে হালকা বৃষ্টির পর শীতের দেখা মিলে।
এ সপ্তাহেই বাতাসে হিমের ছোঁয়া মিলবে। ষড়ঋতুর এই দেশে শীতের আগের ঋতুটি হেমন্ত। এ সময়টায় প্রকৃতিতে চলে বর্ষার বিদায় আর শীতের আগমনের প্রস্তুতি। প্রকৃতিতে শীত আসে একটু একটু করে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে লাল টকটকে হয়ে ওঠে টবের লাল গোলাপ। শীতের শুষ্ক প্রকৃতির অপবাদ ঘোচাতে এ সময় গাঁদা, মলিস্নকা, গোলাপ, ডালিয়া, কসমস ফিরে পায় পূর্ণ জৌলুস ও গাঢ় হয় কলাপাতার রঙ। রহস্যময় কুয়াশায় প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ছাতিম আর শিউলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। চিরচেনা সেই গন্ধই জানিয়ে দিচ্ছে শীতের বারতা। শিউলির প্রলোভনেই হেমন্তের হাত ধরে আসে শীত। আবহাওয়া অধিদপ্তর কৃষকদের শীতের সবজি রোপণের পূবার্ভাস দিয়েছে।
'আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়... কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এই কাঁঠাল ছায়ায়।' প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আবার ফিরে আসতে চেয়েছেন রূপসী বাংলার হেমন্তের কার্তিকে। ষড়ঋতুর হিসেবে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু'মাস হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত সোনালী প্রহর। ফসলের ডগায় শিশিরবিন্দুর মতো আলতো পরশ ঝুলে থাকে। মধ্য রাত থেকে ভোরে দেখা মেলে কোমল বাতাসে মৃদু কুয়াশা আর শিশিরের মায়াবী খেলা। হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধানে পাক ধরে।
হেমন্তে সবুজ ধানের শীষে বাতাস খেলা করে। তখন চুপিসারে বাংলার ধানের ক্ষেতে নিসর্গে আসে সোনালি আভার দু্যতি। কার্তিকের শেষ দিকে তাই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ে। অগ্রহায়ণে সেই ধান কৃষকের গোলায় ওঠে। আর তখন শুরু হয় নবান্নের আয়োজন। ধান উ?ৎপাদনের ঋতু হেমন্ত। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়েই। সম্রাট আকবর হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণকেই প্রথম মাস ঘোষণা করে খাজনা তোলার প্রচলন করেছিলেন। হেমন্তের আগে শরৎ এবং পরে শীত ঋতু।
আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক বলেন, বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিদায় নিয়েছে। এ কারণে আগামী সপ্তাহে সারাদেশে তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মৌসুমী বায়ুর বিদায়ের কারণে এ সময় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এরপর দক্ষিণা উষ্ণ বায়ু দিক পরিবর্তন করে উত্তরের হিমেল হাওয়ায় পরিণত হচ্ছে। হিমালয় তার বাতাসের ভেলায় পাঠাতে শুরু করবে শীতের আমেজ। অক্টোবরের ২০ তারিখের পরই হিমবুড়ির আগলে রাখা হিম ছড়িয়ে পড়বে দিক-দিগন্তে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক কৃষি পরামর্শক কৃষিবিদ ডক্টর আজিজুল ইসলাম বলেন, সময়মতো শীত আসলে শীতকালীন ফসল গম, ভুট্টা ও চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। শীতের স্বাভাবিক আচরণ ঠিক থাকলে যথাসময়ে আলু, গম, সরিষা ও ভুট্টা ঘরে তুলে একই জমিতে আগাম বোরো ধান চাষ করতে পারবেন কৃষক।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের পাহাড়ি এলাকা ফান্দা গ্রামের কৃষক সৈকত হাজং বলেন, দিনে রোদ ও বৃষ্টি হচ্ছে। আবার রাতে শীত শীত লাগছে। এ মাসে শীত আসলে আমন ধানের ফলন বাড়বে। সবাই শীতের সবজি চাষ করতে পারবে।
প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদ নাজমুন নাহার বলেন, ইট-পাথরের নগরজীবনের চঞ্চলতা-ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতায় নগরবাসী হিমের ছোঁয়াকে ভালোভাবে টাওর করতে পারেন না। আর গ্রামের কৃষকরা হেমন্তকে দেখেন ফসল তোলার ঋতু হিসেবে। শরৎ প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্যের সুচনা করে, হেমন্ত সে সৌন্দর্যের পূর্ণতা দান করে। এ পূর্ণতা বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে আনে। কৃষকের আঙিনা ভরে ওঠে সোনালি শস্যে। ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি নিয়ে আসে প্রেয়সী হেমন্ত।
আকাশে এখন সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। কার্তিকের জোছনা দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে, কেউ একজন দুধের পেয়ালা উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে যেন। রাত নেমে এলে গভীরে, জোছনা পাগল করে নদীরে। কাব্য রসিকরা বলেন, ধবল জোছনার হাতছানিতে কার্তিকের শান্ত নদীও নর্তকী হয়। ক্ষেতের ধান পাকে এই কার্তিকেই। নবান্নের আয়োজন সম্পন্ন করার সময় এখন। খেসারি আর কলাই ফুল বাড়ির পাশের মাঠকে পূর্ণ যৌবনবতী ললনার মতো পরিপূর্ণ করে।