মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

দেবীদুর্গার বিদায় সাঙ্গ হলো উৎসব

যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ছবিটি রোববার রাজধানীর বসিলা থেকে তোলা -নাজমুল ইসলাম

শঙ্খনাদ-উলুধ্বনি, ঢাকের বাদ্যি ও সিঁদুর খেলার আচারে দেবীদুর্গাকে অশ্রম্নভেজা ভালোবাসায় বিদায় দিলেন ভক্তরা। বছর ঘুরে অন্নপূর্ণার আগমনে দেশের মন্দির-মন্ডপে উৎসব আর আনন্দের যে রেশ ছড়িয়েছিল গত কয়েকদিন; দশমী তিথিতে তাকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হলো সেটির। আগামী বছরের অপেক্ষায় থেকে দুর্গতিনাশিনী দেবীকে দেবালয়ে বিদায় জানালেন ভুবনের বাসিন্দারা।

রোববার বিকালে রাজধানীতে বর্ণিল শোভাযাত্রায় দেবীদুর্গাকে নিয়ে গিয়ে ভক্তরা বুড়িগঙ্গায় বিদায় দেন। শোভাযাত্রাটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। শোভাযাত্রাকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি সড়কের দুই পাশ থেকে অন্যরাও যেমন এতে অংশ নেন, তেমনি বিসর্জনের সময়ও উৎসাহ নিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও অনেকে ভিড় জমান নদীর তীরে।

ধুনচি নাচ, ঢাকের বাদ্যে নেচে-গেয়ে নগরীর বিভিন্ন মন্ডপের প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় ওয়াইজঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। বিভিন্ন এলাকার পূজামন্ডপ থেকে ট্রাকে করে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের বসিলাতেও বুড়িগঙ্গায় অনেকে প্রতিমা বিসর্জন করেন।

শারদীয় দুর্গোৎসবে বিজয়া দশমীর দিনটি ভক্তদের কাছে একদিকে যেমন উৎসবের, তেমনি বেদনারও। দোলায় চেপে আগমনী এসেছিলেন মর্ত্যলোকে, আর ঘোটকে চড়ে দেবী ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে।

রোববার বিকাল ৪টায় ঢাকার পলাশীর মোড় থেকে বিজয়া শোভাযাত্রার আয়োজন করে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি।

শোভাযাত্রা শুরুর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) সানা শামীনুর রহমান। তিনি বলেন, পূজা নির্বিঘ্নে করতে তৎপরতার অংশ হিসেবে বিসর্জন ও শোভাযাত্রায় তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সেনাসদস্য এবং সোয়াত টিমের সদস্যরা রয়েছেন। এ ছাড়া সাদা পোশাকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করছে। পরে শোভাযাত্রাটি পলাশী মোড় থেকে জগন্নাথ হল, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর দিয়ে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট গিয়ে শেষ হয়।

এবার ঢাকা মহানগরে ২৫২টি পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক প্রতিমা ওয়াইজঘাটে বিসর্জন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব।

দুর্গোৎসবে এবার তিথির কারণে নবমীর দিনই বিহিত পূজা এবং 'দর্পণ বিসর্জন' হলেও রোববার দশমীর দিন সিঁদুর খেলা, দুর্গাকে মিষ্টি মুখ করানো এবং প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রার আয়োজন রাখা হয়।

এদিন বেলা ১১টা থেকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির-মন্ডপে সিঁদুর খেলায় সংসারের মঙ্গল কামনা করেন সধবা নারীরা। তাদের

সঙ্গে পুরুষরাও যোগ দেন।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বলেন, 'সিঁদুর হলো সধবা নারীর প্রতীক। সধবা নারীরা সিঁদুর দিয়ে সংসারের জন্য কল্যাণের প্রার্থনা করেন।'

দুপুরের পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন মন্ডপের প্রতিমা ট্রাকে করে আসতে শুরু করে পলাশীর মোড়ে। সেখান থেকে পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় ওয়াইজঘাটে বিসর্জনের জন্য।

ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় দেবীর নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, এরই সাঙ্গ হলো বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।

হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন দেবীদুর্গা। তার এই 'আগমন ও প্রস্থানের' মধ্যে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।

মহালয়ার মধ্য দিয়ে ২ অক্টোবর এবারের দুর্গোৎসবের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছিল। ওইদিন থেকেই দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা হয়। এরপর গত বুধবার ষষ্ঠী থেকে পাঁচ দিনের যে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, এদিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।

মাঝে বৃহস্পতিবার নবপত্রিকায় প্রবেশ ও স্থাপনে হয় মহাসপ্তমী। পরদিন শুক্রবার সকালে কুমারী পূজার পাশাপাশি মহাঅষ্টমীর বিহিত পূজা এবং সন্ধিপূজা হয়। শনিবার নবমী এবং দশমীর বিহিত পূজার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় মতে 'দর্পণ বিসর্জন' করা হয়।

শাস্ত্র মতে, এবার দেবীদুর্গা কৈলাস থেকে সপরিবারে মর্ত্যলোকে এসেছেন দোলায় চড়ে, ফিরে যাচ্ছেন ঘোড়ায়। বাঙালি হিন্দুদের মতে, দেবীদুর্গা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দেবী। একই সঙ্গে তিনি 'মাতৃরূপেণ', 'শক্তিরূপেণ'।

গত ২ অক্টোবর মহালয়ার দিন সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের, আগামী ১৬ অক্টোবর কোজাগরী পূর্ণিমার মধ্য দিয়ে শেষ হবে দেবীপক্ষ।

এবার পূজা শুরুর আগেই সারাদেশে ১৮টি পূজামন্ডপে প্রতিমা ভাঙা হয়েছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের। তবে পূজাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর থাকার কথাও বলেছেন তারা।

দুর্গোৎসবে অষ্টমীর দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পূজামন্ডপ লক্ষ্য করে 'পেট্রোল বোমা' ছোঁড়া এবং হামলাকারীদের ছুরিকাঘাতে মন্ডপের চারজন স্বেচ্ছাসেবকের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

পরে এই ঘটনাকে 'ছিনতাই' হিসেবে তুলে ধরে কোতোয়ালি থানায় মামলা করে পুলিশ। সন্দেহভাজন তিনজনকে আটকের তথ্যও দেয় বাহিনীটি।

সবার মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে রোববার সকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বলেন, 'মানুষের মধ্যে আমরা সম্প্রীতির বার্তা দিতে চাই। শুভ চিন্তা নিয়ে সবার পাশে থাকতে চাই। আগামী বছর থেকে যেন সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনীর প্রটোকল নিয়ে পূজা করতে না হয়। মানুষের ভালোবাসা যেন আমরা পাই। মানুষের ভালোবাসায় যেন আমাদের সবার নিরাপত্তা বেষ্টনি হয়। মায়ের কৃপায় যেন আমাদের সবার মধ্যে শুভ চিন্তা জাগ্রত থাকে। আমরা যেন একে অপরের পাশে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সোহার্দ্য নিয়ে থাকতে পারি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে