দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভূমি খেকো আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের হাত থেকে রক্ষা রেহাই পাননি সাঁওতাল আদিবাসীরাও। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপটে জাল দলিলকে আসল বলে ভূমি কর্মকর্তাদের ঘোষণা করাতে বাধ্য করতেন ওই চেয়ারম্যান। ঘোষণার পর পরই সাঁওতাল পরিবারের জমি দখল করতেন। বহু সাঁওতাল পরিবারের জমি বেদখল ও জোরপূর্বক কম দামে কিনে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এক সাঁওতাল পরিবারের বিপুল জমি দখলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে এসেছে। এজন্য সংস্থাটি ওই চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছে।
তদন্তকারী সংস্থা দুদক সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মাঁকড়াই গ্রামের বাসিন্দা সাঁওতাল সুরাই কিচ্চু। তার পিতার নাম শঙ্কর কিচ্চু। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী ১৬৯ নম্বর মাঁকড়াই মৌজার ২৯৬ দাগের ডাঙ্গা শ্রেণির ১ একর ৫৫ শতাংশ জমির মালিক সুরাই কিচ্চু। পরে এসএ জরিপে ওই জমি সুরাই কিচ্চুর দুই সন্তান কঙ্কা মাঝি ও শঙ্কর মাঝির নামে রেকর্ড হয়। তারাই ভোগদখল করছিলেন। পরে পিতা জীবিত থাকা অবস্থায়ই দুই সন্তানের মৃতু্য হয়। স্বাভাবিক কারণেই ভূমির মালিকানা চলে যায় পিতা সুরাই কিচ্চুর কাছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকেই জমিটির ওপর নজর পড়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান (সাবেক) মো. আমিনুল ইসলাম (৬৬) ও তার ছোটভাই মো. আজহারুল ইসলাম মিঠুর (৫৯)। তারা জমিটি কিনে নিয়েছেন বলে নিজেদের নামে জাল দলিল তৈরি করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দুই ভাই জাল দলিলকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আসল দলিল বলে ঘোষণা করতে বাধ্য করান। এমন পরিস্থিতিতে সুরাই কিচ্চু দিনাজপুর জেলা জজ (দ্বিতীয়) আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-৫৬/২০০৮। মামলায় সুরাই কিচ্চুর পক্ষে রায় হয়।
তদন্তে পাওয়া তথ্যমতে, আদালতের রায় উপেক্ষা করে উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ও তার ভাই জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে আবারও সুরাই কিচ্চু দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ সহকারী জজ আদালতে জমি যাতে আরও কেউ দখল করতে না পারে, এজন্য চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ৫৫/২০০৯ নম্বর মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলায়ও সুরাই কিচ্চুর পক্ষেই রায় দেন আদালত।
সূত্র বলছে, ভূমি আইনে আদিবাসীদের জমি বিক্রি করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে অবহিত করে অনুমতি নিতে হয়। সুরাই কিচ্চু সেই আইন মেনে পরে ওই জমি থেকে ৮০ শতাংশ বিক্রির অনুমতি চেয়ে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন। এমন আবেদনের প্রেক্ষিতে নিয়মানুযায়ী ২০৪/০৮/২০২১২-১৩ মামলা হয়। এটি মামলা হিসেবে আইনগতভাবে বলা হলেও, এটিকে আদিবাসী মামলা বলা হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে ২০২১ সালের ৯ জুন সুরাই কিচ্চুকে জমি বিক্রির অনুমতি দেয়। ওই বছরের ১৮ জুন দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জমি বিক্রির অনুমতিপত্রও দেয় সুরাই কিচ্চুকে।
তদন্তে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, পরে সুরাই কিচ্চু ওই দাগের ৭৫ শতাংশ জমি বিক্রির জন্য আবারও দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় বরাবর ২০১৩ সালে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি অনুমতি দেয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি জমি বিক্রির অনুমতিপত্রও দেয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
সূত্র বলছে, পরে সুরাই কিচ্চু পুরো জমি দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালি থানাধীন খেকহাঁটি গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান আকন্দের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হানিফ আকন্দের কাছে সাবকবলা দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করেন। হানিফ আকন্দ জমি দখলে গেলে তাতে বাধা দেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার ছোট ভাইয়ের গড়ে তোলা বিশাল বাহিনী। বাহিনীটি এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে পরিচিত।
এমন পরিস্থিতিতে দুই ভাই বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ওই জমি বিক্রির বায়না দলিল করে অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নেন। যাদের সঙ্গে জমির জাল দলিল করে বায়না করেন, তাদের জমিতে গিয়ে ঘর তুলে বসবাস করতে বলেন। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তার বাহিনী দিয়ে ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জোরপূর্বক জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ করান। অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে আসার পর বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের দিনাজপুর জেলার উপসহকারী পরিচালক মোছা. কামরুন্নাহার সরকার সার্বিক অনুসন্ধান পর্যালোচনা করেন। পর্যালোচনা শেষে গত ৯ অক্টোবর অভিযুক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি দেন। সে মোতাবেক দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দুদকের দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোছা. কামরুন্নাহার সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। সেই মোতাবেক দায়িত্বশীল দুদক কর্মকর্তাকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মামলা দায়েরের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলা তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকার সেগুনবাগিচাস্থ প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে যায়যায়দিনকে বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সুরাই কিচ্চু ও জমির ক্রেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ আকন্দ যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু সাঁওতাল আদিবাসী নয়, সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ মানুষই এই উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়ের গড়ে তোলা বাহিনীর হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের মূল টার্গেট ছিল জমি দখল। জমি দখল করতে গেলেই অনেকেই ভয়ে তাদের সঙ্গে দফারফা করতেন। তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মীমাংসা করে নিতেন। তৃতীয় পক্ষটিও ছিল চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়ের পকেটের লোকজন। মূলত সবই ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থবিত্ত হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল। বহু মানুষ তাদের হাতে হেনস্তা হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে আর নানাভাবে হয়রানির ভয়ে অনেকেই মুখ খোলেননি। তবে চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকেই। অনেকেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দুই ভাই ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।