সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি

সংকট কাটেনি, দুর্ভোগে দুর্গতরা

ময়মনসিংহে ৮৯ হাজারের অধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত নেত্রকোনায় গ্রামীণ সড়ক ডুবে ক্ষতি প্রায় ২শ' কোটি টাকা শেরপুরে মানুষ ও পশু খাদ্যের অভাব

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশের তিন জেলা- শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় সৃষ্ট বন্যার পানি ধীরগতিতে কমছে। উন্নতি হচ্ছে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এসব এলাকার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠছে। তবে পানিবন্দিদের সংকট ও দুর্ভোগ এখনো কাটেনি। বানভাসিরা বাড়িঘরে ফিরলেও অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় প্রয়োজনীয় যোগাযোগেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। দেখা দিয়েছে মানুষ ও পশু খাদ্যের অভাব। বাড়ছে পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। বিশেষ করে বন্যাকবলিত এলাকায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও সড়কে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ময়মনসিংহে ৮৯ হাজারের অধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় বন্যার পানি কমছে ধীরগতিতে। পানি নেমে গিয়ে ভেসে উঠছে দুর্গত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বন্যাকবলিত এলাকায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও সড়ক বিভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুরে ৮৯ হাজার ৫৫০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩১ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমির আমন ধান। শুধু আমন ধানে ৩১৩ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মৎস্য খাতে তিনটি উপজেলায় ১৪ হাজার ৯৪৫ মাছের খামার তলিয়ে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ধোবাউড়া উপজেলার ২৬টি গ্রামে ২ হাজার ২০০ পরিবার এখনো পানিবন্দি। এ উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া, বাঘবেড়, গোয়াতলা ও ধোবাউড়া সদরে ধীরে ধীরে পানি কমছে। মানুষের ঘর থেকে পানি নামলেও উঠানে রয়েছে পানি। আশ্রয়কেন্দ্রেও রয়েছেন অনেক মানুষ। পানি সরতে শুরু করায় বন্যার ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠছে। শনিবার বন্যার নবম দিনে মানুষের খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শনিবার সকালে গোয়াতলা ইউনিয়নের তারাইকান্দি গ্রামের রুমেছা খাতুনের বাড়ির উঠানে পানি দেখা গেছে। রুমেছা বলেন, 'আগেও পানি আইছে, কিন্তু এই রহম পানি আর আইছে না। পানি কমনের নামই নাই। আলস্নায় জানে আর কই দিন পানিত কষ্টে থাহন লাগব।' ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বলেন, পানি খুব ধীরে ধীরে কমছে। গ্রামগুলোতে মানুষের ঘর থেকে পানি নেমেছে, তবে উঠানে পানি আছে। ১৯৮৮ সালের পর এমন পরিস্থিতি হয়নি। কবে নাগাদ পানি সরতে পারে তা ধারণা করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ফুলপুর উপজেলার বন্যাকবলিত ছনধরা, সিংহেশ্বর, ফুলপুর সদর, বালিয়া ও রূপসী ইউনিয়নের ৩২টি গ্রামে ৪ হাজার ৫০০ পরিবার এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে। ফুলপুরের ইউএনও এ বি এম আরিফুল ইসলাম বলেন, বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে পানি খুব ধীরগতিতে নামছে। পানি নেমে যেতে কত সময় লাগবে তা বলা সম্ভব নয়। ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বোরাঘাট নদীর পানি বেড়ে হালুয়াঘাট উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। উপজেলার নড়াইল, বিলডোরা ও শাকুয়াই ইউনিয়নে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দি আছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন বলেন, ঘরের ভেতরে পানি, চৌকির ওপর বসে থাকতে হচ্ছে। তবে কংস নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকার বাড়িঘরে পানি আছে। নেত্রকোনায় গ্রামীণ সড়ক ডুবে ক্ষতি প্রায় ২শ' কোটি টাকা নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে পানি কমলেও বাসিন্দাদের সংকট ও দুর্ভোগ এখনো কাটেনি। দুর্গত ব্যক্তিরা বাড়িঘরে ফিরলেও অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না। এসব এলাকার অনেক গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকায় প্রয়োজনীয় যোগাযোগেও তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। জেলার সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, জেলার সাড়ে ছয়শ' কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ডুবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর উপজেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এতে অন্তত ২৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়। গত মঙ্গলবার থেকে পানি কমতে শুরু হলেও এখনো বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আমন, শাকসবজির ক্ষেত ও ঘরবাড়িতে পানি রয়েছে। বন্যার পানির কারণে ২১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় ২৮৫ কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচাপাকা সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। পানির নিচে ডুবে আছে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ফসল। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, জেলার সব নদ-নদীর পানিই দ্রম্নত কমছে। সব মিলিয়ে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। এদিকে বন্যায় জেলার সড়কপথে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এজিইডি) নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জেলায় এলজিইডির আওতাধীন ৫ হাজার ৯৫৩ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার পিচঢালা সড়ক। বাকিগুলো সিসি, আরসিসি, মেগাডম, কার্পেটিং ও কাঁচা সড়ক। বন্যার পানিতে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার সড়কপথ তলিয়ে যায়। আর এখনো ২৫০ কিলোমিটার সড়ক পানির নিচে আছে। যেসব সড়ক থেকে পানি নেমেছে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে যাওয়ায় অধিকাংশ সড়ক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'সব মিলিয়ে বন্যা পরিস্থিতি এখন উন্নতির দিকে। মানুষের কিছু দুর্ভোগ তো হচ্ছেই। আমরা ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রেখেছি। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটসহ অন্য বিষয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রম্নত সমাধান করা হবে।' শেরপুরে মানুষ ও পশু খাদ্যের অভাব শেরপুর প্রতিনিধি জনান, জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও নকলা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। তৈরি হয়েছে মানুষ ও পশু খাদ্যের সংকট। শেরপুরে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠতে শুরু করেছে। ঘরবাড়ি, আবাদ ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বন্যাকবলিতরা। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবারের পাশাপাশি গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। বাড়িঘর হারিয়ে অসহায় অনেক পরিবার নিস্ব হয়ে গেছে। বিশেষ করে যাদের মাটির ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, তারা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ভীষণ কষ্টে অমানবিক দিনযাপন করছেন। জরুরি ভিত্তিতে তাদের অন্তত থাকার ব্যবস্থা করতে অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও ঘর করার জন্য পুনর্বাসন সহায়তা প্রয়োজন। এজন্য ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কামনা করেছেন। সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে মেডিকেল টিম কাজ করছে।