বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ঢাকার কেরানীগঞ্জে পুরনো চাঁদাবাজদের জায়গায় আসছে নতুন চাঁদাবাজ। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে চাঁদাবাজির ধরনও। নানা কৌশলে নীরব চাঁদাবাজির বিষয়টি ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পরিবহন সেক্টরসহ এমনকি ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে চাউর। ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিগত ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা-ছোট নেতা কারও যেন নিস্তার নেই চাঁদাবাজদের হাত থেকে ফসকে যাওয়ার।
অনুসন্ধান ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় টার্গেট শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক এলাকা, বাস-সিএনজি স্ট্যান্ড, নৌ-ঘাট ও হাটবাজার। এই চাঁদাবাজদের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের অনুগত হয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যবসায়ী আর বাসিন্দারা অতিষ্ঠ ছিলেন এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের অত্যাচারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেই সরকার পতনের পর নির্যাতিতরা ভেবেছিল তাদের ভাগ্যে বোধ হয় পরিবর্তন আসবে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেনি। বিগত সরকারের আমলের চাঁদাবাজদের ছেড়ে যাওয়া শূন্য আসন পূর্ণ হতে সময় লাগেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা, শুভাঢ্যা, আগানগর, শাক্তা, রোহিতপুর, বাস্তা, তেঘরিয়া, কোন্ডা ও হযরতপুর ইউনিয়নসহ ১২ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টেই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দখল ও চাঁদাবাজি। আর এই চাঁদাবাজরাও বর্তমান সময়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু অসাধু নেতার আশীর্বাদপুষ্ট।
উপজেলার কদমতলি গোলচত্বর সন্ধ্যার পর ফুটপাতে মোবাইল সামগ্রী বিক্রয়কারী হকারদের কাছ থেকেও নতুন মুখ চাঁদা নিচ্ছে উলেস্নখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হকার বলেন, 'সরকার পতনের পর কয়েক দিন চাঁদা দিতে হয়নি। এখন নতুন একজন এসে টাকা নিয়ে যায়। তার নাম এখনো জানা সম্ভব হয়নি। এ উপজেলার চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় রাজত্ব আগানগর ইউনিয়নে কদমতলি গোলচত্বর, ব্রিজঘাট বাজার, জিনজিরা ফুটপাত, সিট কাটিং মার্কেট, রোহিতপুর-রামেরকান্দা স্ট্যান্ড বাজার, শাক্তার খোলামোড়া বাজার নৌ-ঘাট, কলাতিয়া বাজার, তেঘরিয়া আব্দুলস্নাহপুর গাড়ি পার্কিং স্পট, স্ট্যান্ড বাজার, কোন্ডা মোলস্না বাজার, নৌ-ঘাট ও শুভাঢ্যার হাসনাবাদ স্ট্যান্ড এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।'
তিনি বলেন, 'আগে এসব এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত 'কিশোর গ্যাং লিডার রাসেল, ফরিদ, আব্দুলস্নাহ, আতাউর, রাজিব, মোস্তান, মাসুদ, অপু, তাহের, জিলানী, জসীম, জুয়েল, টিটু, মুসলিম, এমরাত, দাদন ও রমজান' সিন্ডিকেট। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও হাটঘাট ব্যবসায়ী, পরিবহন নেতা নামধারী এই চাঁদাবাজরা এখন সবাই পলাতক। কিন্তু তাতে থেমে নেই ওইসব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের চাঁদাবাজি। এসেছে নতুন মুখ। কদমতলি-জনী টাওয়ার, চুনকুটিয়া-হিজলতলা, মাঠের কোন-বিশ্বরোড, রোহিতপুর-সৈয়দপুরসহ পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। পুরনোর শূন্যস্থানে এখন সক্রিয় 'নতুন মুখের' চাঁদাবাজি।'
আগানগর কাঁচাবাজার ব্যবসায়ি খোরশেদ আলম জানান, 'টোকেন (রসিদ) ছাড়াই খাজনা উত্তোলন করেন ইজারাদাররা। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এই বাজারে কোনো ধরনের চার্ট নেই। ফলে যত খুশি তত টাকা নেন ইজারাদাররা।'
সবজি বিক্রেতা সৌরভ বলেন, 'মীর আসাদ হোসেন টিটু ইজারাদার থাকাকালে দৈনিক ২৫০-৫০০ টাকা খাজনা নিত। কোনো টকেন দিত না। এখন নতুন ইজারাদার চার্ট অনুযায়ী কম নিচ্ছে না বেশি নিচ্ছে তা আমরা বলতে পারি না।'
কদমতলি গোলচত্বর অটোরিকশা চালক হারুনুর রশিদ ও লেগুনা চালক বাচ্চু মিয়াসহ ট্রাক-পিকআপ স্ট্যান্ডের একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, '৫ আগস্টের পরও আমরা চাঁদা দিতে না চাইলে তারা দল বেঁধে লাঠি নিয়ে কখনো গাড়ির গস্নাস ভাঙে আবার কখনো বা মারতে আসে। সারাদিন যতবার গাড়ি বের করি ততবারই চাঁদা দিতে হয়।'
জাকির নামে আওয়ামী লীগের এক নেতা গোলাম বাজার ব্যবসায়ী হিরাকে গত ৪ অক্টোবর, মারধর ও দোকান ভাঙচুর করে গা-ঢাকা দিয়েছে। হিরা লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল জাকির, আনোয়ার ও শাহীন সন্ত্রাসী বাহিনী। তিনি তা দিতে পারেননি। সে কারণেই তাকে মারধর করা হয়েছে, দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অর্থের বিনিময়ে নিজেদের রক্ষা করতে মরিয়া। বিগত বছরগুলোতে নিজেদের কুকর্ম ডাকতে প্রভাবশালী এসব চাঁদাবাজদের ম্যানেজ করেই ফিরছেন জনসম্মুখে।
ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী বলেন, 'অন্যায়, অপশাসন, চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব প্রতিরোধে বিএনপি সর্বশক্তি নিয়োগ করে জনগণের পাশে থাকবে। কোনো চাঁদাবাজ, দখলদারকে ছাড় দেওয়া হবে না। এই চাঁদাবাজরা হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।' তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি করেন এই নেত্রী।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ জানান, 'চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। যে দলের বা মতেরই হোক না কেন, তারা চিহ্নিত অপরাধী। তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও মডেল সব থানার পুলিশ এ বিষয়ে কাজ করছে।'