চলতি বছরের ৭ মাসে শুধু কৃষি কাজের সময় বজ্রপাতে ১৫৭ জন কৃষকের মৃতু্য হয়েছে। তবে সংবাদপত্র ও অন্যান্য সূত্রে কৃষকের মৃতু্য সংখ্যা ২৫০ জনের বেশি। মানুষ হতাহতের ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বজ্রপাতের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক রয়েছে। এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বজ্রপাতে মৃতু্যর চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ আহত হন। এই আহতরা যখন মারা যান, তখন আর হিসাবে ধরা হয় না। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধও নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ধাতব পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যার আধিক্য, বনভূমি কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ। বজ্রপাতে বাংলাদেশে মৃতু্যর সংখ্যা বিশ্বে শীর্ষে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম জানিয়েছে, বজ্রপাত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, অর্ধেকই বাংলাদেশে। এ জন্য বাংলাদেশে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর সংগঠনটি জানায়, কৃষি কাজের সময় বজ্রপাতে ১৫২ জন কৃষকের মৃতু্য হয়েছে। এছাড়া গরু আনতে গিয়ে ১৮ জনের মৃতু্য হয়েছে, মাছ ধরার সময় ৫২ জেলের মৃতু্য হয়েছে। আম কুড়ানোর সময় ১১ জন, ফাঁকা রাস্তায় চলাচলের সময় ১৫, ঘরে থাকাকালীন ২৭, পাথর উত্তোলনের সময় ৩, বাড়ির আঙ্গিনায় খেলার সময় ১৪ শিশু-কিশোর ও গাড়িতে থাকাকালীন ১ জনের মৃতু্য হয়েছে। এই সময়ে বজ্রপাতে মোট মৃতু্য হয়েছে ২৯৮ জনের।
এরপর ৮ অক্টোবর ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ১ জন কৃষকের মৃতু্য হয়। ৯ অক্টোবর কুষ্ঠিয়ার দৌলতপুরে ৪ কৃষকের মৃতু্য হয়। এ নিয়ে সাত মাসে ১৫৭ জন কৃষকের মৃতু্য হয়েছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ জন, ফেনী ১২, কক্সবাজারে ১০, জয়পুরহাটে ১৩, হবিগঞ্জে ১৩ এবং গাইবান্ধায় ১০ জন। ধান কাটা, ঘাস কাটা, গরু আনা ও নানান ধরনের কৃষি কাজের সময় বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবার বলেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও বায়ুদূষণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রয়েছে হিমালয়। সাধারণত বর্ষা আসার আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। একসঙ্গে দুই রকমের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘের আবহ তৈরি হয়। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে।
তিনি আরো জানান, বজ্রপাত ঠেকাতে ১০ কোটি তাল গাছ লাগানোর প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে ১০ বছরে
৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা যায়, দেখভাল ও যত্নের অভাবে তাল গাছ মারা যাচ্ছে। অনেক এলাকায় তাল গাছের চারা গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। তাই এ প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে সরকার।
ভারতীয় আবহাওয়া অফিস ও জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার ৪০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদু্যৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃতু্যর জন্য ১০০ ভোল্টের বিদু্যৎ যথেষ্ট। বজ্রপাতে একজনের মৃতু্য হলে আরও ১০ থেকে ১৫ জন আহত হয়ে থাকেন। আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যান। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গবাদি পশু মারা যায়।
আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুর রশিদ বলেন, বজ্রপাতের সময় ছাউনবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যতে হবে। কোন বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা ঘরে থাকা ভালো। বজ্রপাতে মৃতৃ্য কমাতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হাঁটার দুরত্ব বেঁধে ইটের অস্থায়ী ঘর করে দিতে হবে। যেখানে কৃষক ও মাঠে কাজ করা মানুষ কিছু সময় সুরক্ষার জন্য দাঁড়াতে পারেন। বজ্রঝড় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় থাকে না। মাঠে যারা কাজ করেন তারা যদি ওই সময়টা পাকা ঘরে আশ্রয় নিতে পারেন তাহলে মৃতু্য হার কমানো সম্ভব হবে। দেশে বজ্রপাতে মৃতু্যর ৯৮ শতাংশই ঘটেছে বাইরে থাকার কারণে।
পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়ন এ প্রকাশিত গবেষণা 'বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ' এ বলা হয়েছে, বেশির ভাগ প্রাণহানিবর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডক্টর আক্রম হোসেন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান, উঁচু গাছ কাটা, পাহাড় কাটাসহ নানা কারণে দেশে প্রতি বছরই বজ্রপাতে। বজ্রপাতে মৃতু্য রোধে আগাম সতর্কতার জন্য লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসানোসহ নানা উদ্যোগের পরও কমছে না মৃতু্য। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে মৃতু্য আরো বাড়বে। সরকার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আট জেলায় বজ্রপাতের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ যন্ত্রস্থাপন করছে। দক্ষ জনবলের অভাবে যা কাজে আসছে না। জেলেদের জন্য ছাউনি ও উপকূলীয় এলাকায় বজ্রপাত নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
বজ্রপাত ঠেকাতে সারাদেশে এক কোটি তালগাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা যায়, তালগাছের চারা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গরু-ছাগল খেয়ে নিয়েছে। নিয়মিত যত্ন না নেওয়ার কারণেও অনেক গাছ নষ্ট হয়। একটি তালগাছ বড় হতে ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। তাই শত কোটি টাকা ব্যয়ের পর তালগাছ লাগানো প্রকল্প বাতিল করেছে সরকার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন 'ডিজাস্টার ফোরাম'-এর তথ্য মতে, দেশে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন এবং ২০২১ সালে ৩৬৩ জন, ২০২২ সালে ২৭৯ জন, ২০২৩ সালে বজ্রপাতে মারা যায় ৩৪০ জন।