অনুমোদনহীন রিক্রুটিং এজেন্সির দালালদের হাতেই ভিসা বাণিজ্য
সাধারণ মানুষ ভিটে-মাটি বা স্বর্ণ অলঙ্কার বিক্রি করে অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর লোভনীয় অফার আর কথার মারপ্যাচে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে
প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বিশেষ প্রতিনিধি
শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি। সারাদেশে তারা গড়ে তুলেছে দালাল চক্রের সিন্ডিকেট। কালো তালিকাভুক্ত অনুমোদনহীন এসব রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যাঙের ছাতার মতো রাজধানীর অলিতে গলিতে অফিস নিয়ে অবৈধ ভিসার রমরমা বাণিজ্য করছে। এসব এজেন্সির প্রতারণার কারণে বহু মানুষ পথে বসেছে। স্বপ্নের দেশে যেতে সাধারণ মানুষ ভিটে-মাটি বা মায়ের স্বর্ণ অলঙ্কার বিক্রি করে অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর লোভনীয় অফার আর কথার মারপ্যাচে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে। এ যেন অনুমোদনহীন রিক্রুটিং এজেন্সির দালালদের হাতেই ভিসা বাণিজ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি মালেয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ঘিরে বাংলাদেশের অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দালাল চক্র সারাদেশে প্রতারণায় নেমেছে। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে ৮ আগস্ট পুনরায় উন্মুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ২২ মাস সময়ে সীমিত সংখ্যক ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পৌনে পাঁচ লাখ কর্মী মালয়েশিয়া গিয়েছেন। এ সকল কর্মীরা প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী কাজ পেয়েছেন। তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মীগণ রেমিট্যান্স প্রেরণের দিক দিয়ে অষ্টম থেকে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২২-২৪ সময়ে সীমিত সংখ্যক ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও সরকারি তালিকা বহির্ভূত অনুমোদনহীন ৭৩৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিসহ দালাল-মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্ট মিলে ১১০০টি বেশি এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হচ্ছে। বায়রা'র অধিকাংশ সদস্য মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। তারা অধিক ব্যবসা করলেও কর্মীদের জন্য ভালো কর্মের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এ ছাড়াও কালো তালিকাভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমেও কর্মী পাঠাচ্ছেন অনেকে। এসব কর্মীরা বিদেশ গিয়ে অবৈধ হয়ে অন্ধকার কারাগারে ঘানি টানছেন।
প্রবাসী বিশেষজ্ঞ খবীর উদ্দিন বলেন, অনুমোদনহীন ও অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, ভিসাপ্রাপ্ত সকল কর্মী মালয়েশিয়া না যেতে পারাসহ বিভিন্ন ভাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি প্রক্রিয়াটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশের জনশক্তি রপ্তানি সেক্টর দিনের পর দিনের মানুষের বিশ্বাস হারাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
ডিমল্যান্ড জনশক্তি রপ্তানি কারক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আব্দুল করিম বলেন, প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে প্রায় প্রতিনিই প্রতারণা করা হচ্ছে। তারপর বছরের পর বছর দালালদের পিছনে ঘুরেও বিদেশ যাওয়া হয় না অনেকের। এসব কারণে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বায়রার সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ছাড়াও অনুমোদহীন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে একই সময় প্রায় ৮ লাখ কর্মী মালয়েশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপাচ্যে গেলেও তাদের অধিকাংশ কাজ পায়নি। আবার অনেকে চোরাইপথে প্রবেশ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেলখানায় মৃতু্য প্রহর গুনছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৫২০টি বৈধ লাইসেন্স থেকে মালয়েশিয়া সরকার প্রাথমিকভাবে ২৫টি লাইসেন্স এবং পরবর্তীতে সরকারি খাতের বোয়েস্যেলসহ মোট ১০১টি লাইসেন্স তালিকাভুক্ত করে। সমঝোতা স্মারক বা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রম্নপ মিটিং-এ সম্মত কার্যবিবরণীতে সহযোগী এজেন্সি বা নিয়োগকর্তা কর্তৃক স্থানীয় (ঢাকায়) এজেন্ট নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং, সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি বা নিয়োগকর্তা কর্তৃক নিয়োজিত এজেন্টের কোনো কাজই বিধি সম্মত নয়। তা সত্ত্বেও তালিকাবহির্ভূত রিক্রুটিং এজেন্সি অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে শুরু করে। এতে পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠেছে। আবার যে কোনো সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়া বন্ধ করতে পারে। যা দেশের জনশক্তি রপ্তানি সেক্টর এবং বিশেষত কর্মীদের জন্য মঙ্গলজনক নয়।