সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি

শেরপুরে ভেসে উঠছে ক্ষত ২ জেলায় ধীরে কমছে পানি

বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট তিন জেলার দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষের ক্ষতি

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলা- শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভেসে উঠতে শুরু করেছে বন্যার ক্ষত। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা। বন্যার পাঁচ দিনে এই জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। অন্যদিকে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলায় বন্যা উপদ্রম্নত এলাকা থেকে ধীরে কমছে বন্যার পানি। বিপৎসীমার নিচে রয়েছে নদ-নদীর পানি। ফলে দুই জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপদ্রম্নত এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, বুধবার বিকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আলী রেজা জানিয়েছেন, তিন জেলায় এ পর্যন্ত দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আটজন শেরপুরে ও দুইজন ময়মনসিংহের বাসিন্দা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পানি নেমে যাওয়ার পর শেরপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদীতে বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ ভেসে উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে বাড়িঘরে সঁ্যাতেসঁ্যাতে অবস্থা ও কাদা পানিতে একাকার হয়ে থাকায় এবং চুলায় পানি উঠায় রান্নাবান্না করতে পারছেন না বেশিরভাগই। গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। কোথায়ও রাস্তা ভেঙে গেছে, কোথাও বড় বড় গর্ত, খানা-খন্দে ভরে গেছে। আবার কোথাও এখনো জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এ ছাড়া ক্ষেতের ফসল ডুবে নষ্ট হওয়ায় আগামী দিনে কীভাবে চলবেন, এসব ভেবেও অনেক কৃষক পরিবার এখন দিশেহারা। ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের কুশাইকুড়া গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'এমনভাবে সব কিছু তছনছ হয়েছে, তা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। ঢলের পানির তান্ডবে আমাদের বাড়িভিটায় ২০-২৫ ফুট গর্ত হয়ে গেছে। আমরা ঘরের কোনো কিছু বের করতে পারিন। এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে জীবনটা রক্ষা করেছি। পানি নেমে যাওয়ার পর শুধু কয়েক ফর্দ টিন ও কিছু জিনিসপত্র পেয়েছি। আসবাবপত্র, টাকা-পয়সা, ধানচাল যা ছিল, সবই ভেসে গেছে।' এদিকে পানি কমতে শুরু করায় সদর উপজেলার গাজীরখামার, ধলা, বাজিতখিলা ও পাকুরিয়া ইউনিয়নের আংশিক এবং নকলা উপজেলার নকলা, উরফা, গণপদ্দী ও গৌরদ্বার ইউনিয়নের আংশিক এবং নকলা পৌরসভার আংশিক এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কৃষক হাজি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'রাস্তার মধ্যে কোমর পানি। বাড়িঘরে পানি। খাওয়া-পিন্দা অসুবিধা। চুলার মধ্যে পানি পাকশাক করা যাইতাছে না। বন্যার আবাদ ফসল, ঘরবাড়ি নষ্ট অইলো। গাছগাছালি নষ্ট অইলো।' কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় রোপা আমনের ৪৬ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমির ধান, এক হাজার ৬২ হেক্টর জমির সবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বস্তায় আদা চাষ। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে চার লাখ ৬৯ হাজার ২৯৪টি বস্তার আদা। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, 'জেলার পাহাড়ি নদী মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেলস্নাখালীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার সকালে নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর পানি কমে নালিতাবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৮৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নাকুঁগাও পয়েন্টে ৩৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চেলস্নাখালী নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমার ৫২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।' শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নকলায় পানি বেড়েছিল, তা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভালো লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। পানি পুরোপুরি সরে যাওয়ার পর কৃষি, মৎস্য ও ঘরবাড়িসহ ক্ষয়ক্ষতি কোনো সেক্টরে কেমন হয়েছে তা জানার পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।' জেলায় এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃতু্য হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আপাতত বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে টেউটিন ও নগদ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা পুরোদমে চলছে।' ময়মনসিংহ-নেত্রকোনায় ধীরে কমছে পানি এদিকে, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা থেকে ধীরে কমছে বন্যার পানি। বুধবার সকাল পর্যন্ত নতুন করে কোনো এলাকা পস্নাবিত হয়নি। তবে কিছু এলাকায় অপরিবর্তিত রয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে পানিবাহিত রোগ ছাড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই জেলায় প্রশাসনের পাশাপাশি ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী-র?্যাবসহ স্বেচ্ছাসেবীরা। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে বলে জানিয়ে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এ.বি.এম. আরিফুল ইসলাম বলেন, 'প্রশাসনের স্থাপন করা কন্ট্রোলরুমে ত্রাণের জন্য মানুষ ফোন করছে। আমরা বন্যাদুর্গত বাসিন্দাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।' ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের নড়াইল ইউনিয়নের বিকেকে হাইস্কুলে বুধবার সকাল ৯টায় মেডিকেল ক্যাম্পেইন শুরু করেছে সেনাবাহিনী। হালুয়াঘাটে তিনটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. এরশাদুল আহমেদ। তিনি বলেন, ৯টি ইউনিয়নের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিশাত শারমিন জানান, পানিবন্দি এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে। বন্যা-পরবর্তী সময় এর প্রভাব আরও বাড়তে পারে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, নেত্রকোনায় বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করছে। তবে পানি কমলেও মানুষের সংকট কাটেনি। যারা আশ্রয়কেন্দ্র বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরছেন, তাদের অনেকেরই ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। ঘরের ধান-চাল পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খাবারের জন্যও নিম্ন আয়ের এসব মানুষকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। জেলার বেশির ভাগ গ্রামীণ রাস্তাঘাট এখনো পানির নিচে থাকায় কাজের সন্ধানে সহজে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। পানির নিচে আছে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত। এখনো ২৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। পানিবন্দি আছেন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। এসব মিলিয়ে বন্যার্তরা বিপদের মধ্যে আছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বলেন, 'মঙ্গলবার দুপুর থেকে কংস, সোমেশ্বরী, ধনু, উব্দাখালীসহ সব নদ-নদীর পানিই দ্রম্নত কমছে। তবে এখনো উব্দাখালী নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৬ দশমিক ৫৫ মিটার। অন্য নদ-নদীগুলোয় পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে আছে। আশা করা যাচ্ছে, এসব নদ-নদীর পানি ধনু হয়ে মেঘনায় দ্রম্নত নেমে যাবে।' স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নেত্রকোনা কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জেলায় এলজিইডির আওতাধীন পাঁচ হাজার ৯৫৩ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে এক হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার পিচঢালা সড়ক। বাকিগুলো সিসি, আরসিসি, মেগাটম, কার্পেটিং ও কাঁচা সড়ক। পানিতে তলিয়ে যাওয়া যেসব সড়ক থেকে পানি নেমে গেছে, অধিকাংশ সড়ক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। স্রোতে স্থানে স্থানে ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় পাকা সেতু, বক্স কালভার্টসহ সংযোগ সড়ক বন্যায় ধসে গেছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জেলার ১০টি উপজেলায় এক লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, বুধবারের তথ্য অনুযায়ী, আকস্মিক বন্যায় ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ১৭৭ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর বলেন, বন্যায় এক হাজার ৪৮০টি পুকুর ও খামারের ৭২৩ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। আট কোটি ২৪ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। নেত্রকোনায় এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা, তিন হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৮০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া সমন্বয় করে বিভিন্ন এনজিও, সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। তিন জেলার দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষের ক্ষতি বুধবার বিকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আলী রেজা জানিয়েছেন, তিন জেলায় এ পর্যন্ত দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আটজন শেরপুরের এবং দুইজন ময়মনসিংহের বাসিন্দা। বন্যা পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরে অতিরিক্ত সচিব বলেন, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার ১৩টি উপজেলা এবারের বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ ৭৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। মোট ৬৩ হাজার ১৭১টি পরিবার বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্য দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৯১ জন। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে মোট ১৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মোট এক হাজার ৩৩৭ জন সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে ৫৬১টি গবাদিপশু। তিন জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ২০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে তিনি জানান, ময়মনসিংহ বিভাগের জিঞ্জিরাম, ভুগাই-কংস ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইলেও পানির সমতল এখন হ্রাস পাচ্ছে। আগামী তিন দিন ময়মনসিংহ বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকায় এ সময় ওই তিন নদীর পানি আরও কমবে এবং নেত্রকোনা জেলার সোমেশ্বরী ও জামালপুর জেলার জিঞ্জিরাম নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।