ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ আর কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে বুধবার ঢাকাসহ সারাদেশের মন্দির-মন্ডপে মহিষাসুর মর্দিনী দেবীর আবাহন, ঘটস্থাপন ও মহাষষ্ঠীর কল্পারম্ভের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। শারদীয় দুর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ মহাসপ্তমী। এদিনও ধূপ, পঞ্চপ্রদীপ, উলুধ্বনি আর ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে মন্দিরে-মন্ডপে উচ্চারিত হবে পুরোহিতের মন্ত্রধ্বনি ও পূজার্চনা।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটের মধ্যে নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন ও সমাসপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশের পর ঘটস্থাপন শেষে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন মন্দিরের পুরোহিত।
পুরাণ মতে, নবপত্রিকা প্রবেশ দুর্গাপূজার এক বিশেষ অঙ্গস্বরূপ। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। যদিও বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, ৯টি উদ্ভিদ। উদ্ভিদগুলো হচ্ছে কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।
মূলত একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। স্ত্রীরূপের জন্য দুটি বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম 'কলা বউ'।
কথিত আছে নবপত্রিকার ৯টি উদ্ভিদ দেবী দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীক। এই নয় দেবী হলেন- রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী ঊমা, জয়ন্তাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ড ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্ণী। অর্থাৎ এরাই যেন একত্রে নবদুর্গারূপে পূজিত হন।
সনাতনী শাস্ত্র অনুযায়ী, মহাসপ্তমীতে ষোড়শ উপাচারে দেবী দুর্গার পূজা হবে। অর্থাৎ ষোলোটি উপাদান দিয়ে মহাসপ্তমীর দিনে দেবী দুর্গাকে পূজা করা হবে। এছাড়া দেবী দুর্গার চক্ষুদানের পর ভক্তরা আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, স্নানীয়, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে পূজা করবেন। মন্দিরে পুরোহিত, আয়োজকসহ অনেক পুণ্যার্থী উপবাস থেকে পূজা শেষে অঞ্জলি দেবেন।
এদিকে বুধবার থেকে পূজা শুরু হলেও রাজধানী ঢাকার মন্ডপগুলোতে ভক্ত-দর্শনার্থীদের ভিড় তেমন একটা দেখা যায়নি। আয়োজকরা জানান, আজ মহাসপ্তমী থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়বে। সপ্তমী পূজা উপলক্ষে নানা রঙের পোশাক পরে বিভিন্ন বয়সী মানুষ সকাল থেকে মন্ডপে মন্ডপে হাজির হবেন।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বুধবার জানান, সংকল্প ও আরম্ভ এ দুই মিলিয়ে হয় 'কল্পারম্ভ'। এর মাধ্যমে দেবীর কাছে প্রতিজ্ঞা করা হয়, সমস্ত নিয়ম মেনেই তার পূজার্চনা করা হবে। দেশ এবং সারা বিশ্বে 'অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায়' দুর্গার চরণে গন্ধ, পুষ্প, অর্ঘ্য ও বাদ্য দিয়ে প্রার্থনা করা হয় পূজার প্রথম দিন।
বুধবার ষষ্ঠী পূজার আগে মঙ্গলবার হয় বোধন বা দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। এরপর আজ মহাসপ্তমী, শুক্রবার মহাঅষ্টমী এবং শনিবার মহানবমী ও দশমী। এবার মহানবমী পূজার পরই দশমী বিহিত পূজা হবে।
রোববার বিজয়া দশমীতে দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শেষ হবে। একটি বছরের জন্য 'দুর্গতিনাশিনী' দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, 'এবার দেবী এসেছেন দোলায় চেপে। পালকি বা দোলায় দেবীর আগমন বা গমন হলে এর ফলাফল হয় 'মড়ক', যা শুভ ইঙ্গিত নয়। খাদ্যশস্যে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হবে। রোগব্যাধি বাড়বে। এছাড়া দেবী স্বর্গে গমন করবেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। শাস্ত্র মতে দেবীর গমন বা আগমন ঘোটকে হলে ফলাফল হয় 'ছত্রভঙ্গ'। এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক এলোমেলো অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।'