কালুরঘাট সেতুর ব্যয় বেড়েছে ১০গুণ
প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দক্ষিণ চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সেতুটির উচ্চতা বাড়ার কারণে প্রায় ১০গুণ বেড়েছে ব্যয়। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধছে চট্টগ্রামবাসী।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সোমবার অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে কালুরঘাট সেতু প্রকল্পটি ২০৩০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ৭ হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ)। প্রকল্প ব্যয় আগের মতোই (১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা) অপরিবর্তিত আছে।
জানা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর বিকল্প হিসেবে কর্ণফুলী নদীতে আরেকটি সেতু নির্মাণে ২০১২ সালে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হয়। তখন কালুরঘাট সেতুর সংসদীয় এলাকা চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। তিনি সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ছিলেন। তার মুখ দিয়ে কালুরঘাট সেতুর কথা শুনেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। তারপর এ আসনের সংসদ সদস্য হয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত বাসদ'র এমপি মঈনুদ্দিন খান বাদল। কালুরঘাট সেতু নিয়ে এই ব্যক্তি সংসদে রীতিমতো মুখে ফেনা তুলতেন। সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক কাঠখড় পোড়ালেও নতুন সেতুর অনুমোদন তিনি আর চোখে দেখে যেতে পারেননি। তার মৃতু্যর পর সেই আসনে এমপি নির্বাচিত হন দক্ষিণ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দুর্বলতা কালুরঘাট সেতু নিয়ে তিনিও কম গল্প শোনাননি। দায়িত্বে থাকাকালে তিনি মৃতু্যবরণ করেন। কিন্তু সেতু আর হয়নি।
মোসলেম উদ্দিনের মৃতু্যর পর এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ। এরপর এ আসনের সংসদ সদস্য হন মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুস সালাম। সবার মুখেই এই কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের গল্প শুনেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। কিন্তু কথায় তো চিড়ে ভিজে না; ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকার সেতুর নতুন নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা আগের প্রকল্প ব্যয়ের চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। বেশি ব্যয় বাজেটের কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পটি আর পাস করা হয়নি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট একনেক সভায় কালুরঘাট সেতুর প্রকল্পটি তোলা হলেও নকশা সংশোধন করে আবার একনেক সভায় তোলার নির্দেশনা দিয়ে সেটি ফেরত দেওয়া হয়। পরে বিআইডবিস্নউটিএ কর্ণফুলী নদীর ওপর এ সেতু নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তোলে। তারা সেতুটি নির্মাণে ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতা রাখার জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেয়। এরপর সেতু নির্মাণে আবার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিজিবিলিটি স্টাডি দাখিল করে। এতে কর্ণফুলী নদীর ওপর ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন ও দুই লেনবিশিষ্ট সড়ক পথের সুবিধা রেখে সেতু নির্মাণে প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়। সেতুটির উচ্চতা বাড়ার কারণে প্রায় দশগুণ ব্যয় বেড়ে যায়।
যেভাবে ১ হাজার ১৬৩ কোটি থেকে সাড়ে ১১ হাজার কোটি
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের নকশা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রেল ও সড়ক পথে চলাচলের আলাদা নকশা এবং সড়কের জন্য দুই লেনের পাশাপাশি ডাবল রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত দেন তিনি। এরপর ইডিসিএফ নতুন নকশার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব দেয় দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান 'দহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কো-অপারেশন জেভিকে'।
দ্বিতীয় ওই নকশায় কালুরঘাট রেল-কাম সড়ক সেতুটি পদ্মা সেতুর আদলে দ্বিতল সেতু তৈরির নকশা করা হয়। ওই নকশা অনুযায়ী সেতুর নিচতলায় ডাবল লাইনে রেল এবং ওপরের তলায় দুই লেনে গাড়ি চলার কথা ছিল। ওই নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০২২ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় নকশাটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে প্রধানমন্ত্রী ফেরত পাঠান। তিনি একতলা সেতুতেই ডাবল রেললাইন ও যানবাহন চলাচলের জন্য দুই লেনবিশিষ্ট সড়ক সেতুর নকশা করার নির্দেশ দেন। তারপর নতুন এই নকশা করা হয়েছে। নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন।
ডিপিপি সূত্র জানায়, বর্তমানে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপরে যে পুরনো সেতু রয়েছে তার ঠিক ৭০ মিটার উজানে এই প্রস্তাবিত নতুন সেতু নির্মিত হবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৭০০ মিটার আর এতে নেভিগেশন হাইট বা উচ্চতা হবে ১২ দশমিক ২ মিটার আর এজন্য দুই প্রান্তে সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে ২ দশমিক ৫০ মিটার করে। সমীক্ষা অনুযায়ী নতুন সেতু হচ্ছে ৭০ ফুট। এর মধ্যে ৫০ ফুটে হবে ডাবল গেজ ও মিটার গেজ (এমজি ও বিজি) ডাবল ট্র্যাক। ২০ ফুটের মধ্যে দুই লেনের সড়ক পথ তৈরি করা হবে। প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় হবে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মিত হলে এই সেতু দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রেলওয়ে।
কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের ফোকাল পারসন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) গোলাম মোস্তফা বলেন, 'এখন আমরা কনসালট্যান্ট নিয়োগ করব। ডিটেইল ডিজাইন হবে। ডিটেইল ডিজাইন করতে এক বছর লাগবে। তারপর টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এরপর সেতুর কাজ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শুরু হবে। কনসালট্যান্ট নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে।'
বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন বলেন, '১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে, প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি প্রার্থীদের প্রতিশ্রম্নতিতে সেতুর বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। তবে সেতুর দাবি বরাবর উপেক্ষার শিকার হয়েছে। আবার কখনো আলোর পথে গেলেও গতি ছিল খুবই মন্থর। যে কারণে দশকের পর দশক ধরে অপেক্ষায় থেকে মানুষকে হতাশ হতে হয়েছে।'
উলেস্নখ্য, ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে রেল যোগাযোগের জন্য বর্তমানে কালুরঘাট সেতুটি নির্মিত হয়। পরে ১৯৫৮ সালে এ সেতুটি সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট সেতুতে যান চলাচলে চাপ বাড়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতু হয়ে পড়ে নগরীর সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি উপজেলা ও কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার যোগাযোগের অন্যতম রাস্তা। ২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় এ সেতুটি বন্ধ রেখে সংস্কার কাজ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।