শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু আজ
প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হচ্ছে আজ। সকাল ৮টা এক মিনিটের মধ্যে ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এদিন সকাল থেকে শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠে মুখর থাকবে সব মন্ডপ এলাকা। এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১২ অক্টোবর শনিবার সকালে দশমী বিহিতপূজা শেষে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। আর পরদিন ১৩ অক্টোবর রোববার বিকালে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে ঐতিহ্যবাহী শারদীয় উৎসবের।
দুর্গাপূজাকে আনন্দমুখর করে তুলতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। পূজামন্ডপগুলো সাজানো হয়েছে বর্ণাঢ্য সাজে। মন্ডপের সামনে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন তোরণ। করা
হয়েছে আলোকসজ্জা। পূজা ঘিরে সারাদেশে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এখন বইছে উৎসবের আমেজ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী, ষষ্ঠী তিথির সন্ধ্যায় ধূপের ধোঁয়া, ঊলুধ্বনি, ঢাক-ঢোল-কাঁসর-মন্দিরার চারদিক কাঁপানো শব্দ আর পুরোহিতদের জলদকণ্ঠে- 'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ' মন্ত্রোচ্চারণের ভেতর দিয়ে দূর কৈলাস ছেড়ে দেবী পিতৃগৃহে আসেন।
পূরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। বসন্তে তিনি এ পূজার আয়োজন করেন। এজন্য দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লংকা যাত্রার আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকাল, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। দেবীর শরৎকালের এ পূজাকে 'অকাল বোধন' বলা হয়।
সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার দোলায় (পালকি) চড়ে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন; যার ফল হচ্ছে মড়ক। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। দেবী স্বর্গলোকে বিদায় (গমন) নেবেন গজে (হাতি) চড়ে; যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালীসহ কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার কারণে ওই অঞ্চলের বেশ কিছু মন্দির-মন্ডপসহ দেশের অনেক মন্ডপে এবার পূজা হচ্ছে না। এরপরও এবার পূজামন্ডপের সংখ্যা ৩১ হাজার ৪৬১টি। গত বছর পূজা হয়েছিল ৩২ হাজার ৪০৮টি মন্ডপে। তবে ঢাকা মহানগরীতে পূজামন্ডপের সংখ্যা বেড়েছে। মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির হিসাবে এবার ঢাকা মহানগরীর পূজামন্ডপের সংখ্যা ২৫২টি, যা গতবারের তুলনায় চারটি বেশি। আর নোয়াখালীতে ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ১৮২ মন্ডপে আয়োজন করা হয়েছে দুর্গাপূজার। তবে বন্যার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় পূজা অনেকটা অনাড়ম্বর হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২ অক্টোবর বুধবার মহালয়ার মাধ্যমে এ উৎসবের ক্ষণগণনা শুরু হয়। শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরুতে দক্ষিণায়নে নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙাতে ভক্তরা বন্দনা পূজা করেন। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের পূজার নির্ঘণ্টে বলা হয়েছে, তিথি অনুসারে আজ ৯ অক্টোরর সকাল ৮টা এক মিনিটের মধ্যে ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও বিহিতপূজা সম্পন্ন হবে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হবে শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। কাল ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটের মধ্যে নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন ও সমাসপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। ১১ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ৭টা ১৭ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে মহাষ্টমী পূজা। এছাড়া সকাল ৬টা ৫৩ মিনিটে সন্ধিপূজা শুরু হয়ে সকাল ৭টা ৪১ মিনিটের মধ্যে শেষ হবে। ১২ অক্টোবর সকাল ৬টা ১২ মিনিটের মধ্যে মহানবমী পূজা ও সকাল ৮টা ২৬ মিনিটের মধ্যে দশমীবিহিত পূজা শেষে দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হবে। আর পরদিন ১৩ অক্টোবর বিকাল ৪টায় বিজয়া শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে দেবীমূর্তির বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুগোৎসবের।
প্রতিবছর রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পূজামন্ডপে দুর্গাপূজার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এ বছর মিশন মাঠে পূজার আয়োজন করা হচ্ছে না। ফলে থাকছে না কুমারীপূজার অনুষ্ঠানও।
এবারের দুর্গাপূজা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, পূজা উপলক্ষে দেশজুড়ে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা কঠোর থাকবে।
বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবে বিশৃঙ্খলা রোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ৮৪ হাজার জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুরো বিষয়টি তদারকির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে তথ্য দেওয়া যাবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বৈঠক করে পূজাকে ঘিরে সব রকমের নাশকতা ঠেকাতে মন্ডপগুলোতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার,র্ যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ড মোতায়েন করেছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, দুর্গাপূজা যেন নির্বিঘ্নে হয়, সেজন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৮ দফা নির্দেশনা প্রতিটি পূজামন্ডপে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, এসপি, ডিসি, ইউএনও, ওসিসহ প্রশাসনে যারা রয়েছেন, সবাইকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা থাকবে, আর্চওয়ে-মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তলস্নাশি কার্যক্রম চালানো হবে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েনের পাশাপাশি সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সার্বক্ষণিক বিদু্যৎব্যবস্থা সচল রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবেন। একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এবংর্ যাব সদস্যরা তাদের টহল কার্যক্রমসহ অন্যান্য নিরপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, 'এবার দুর্গাপূজা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি- সরকার, প্রশাসন এবং দেশবাসীর সহযোগিতায় একটি শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ও আনন্দমুখর পরিবেশে পূজা শেষ করতে পারব। এবার মা দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে সব ধরনের অপশক্তি দূরীভূত হয়ে জগৎজুড়ে শান্তির বারতা ছড়িয়ে পড়বে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।'
ছুটি একদিন
বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন
এদিকে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার ছুটি একদিন বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অ্যালোকেশন অব বিজনেস অ্যামং দ্য ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিজ অ্যান্ড ডিভিশন্স (শিডিউল ১ অব দ্য রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬) (রিভাইজড আপ টু এপ্রিল ২০১৭)-এর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অংশের ৩৭ নম্বর ক্রমিকের অনুবলে সরকার আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১০ অক্টোবর নির্বাহী আদেশে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সাধারণ ছুটির সময়ে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
তবে, জরুরি পরিষেবা, যেমন- বিদু্যৎ, পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবা এবং এ সংশ্লিষ্ট সেবা কাজে নিয়োজিত যানবাহন ও কর্মীরা এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবে।
পাশাপাশি হাসপাতাল ও জরুরি সেবা এবং এ সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মীরা এবং ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বহনকারী যানবাহন ও কর্মীরা এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবে।
এছাড়া জরুরি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অফিসগুলো এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবে।
ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। আদালতের কার্যক্রমের বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন।