আলোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার পরিবারের ১২ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আদালত। সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। শুনানিকারী দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া অন্যরা হলেন সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, দুই ছেলে আশরাফুল আলম ও আহসানুল আলম; ছয় ভাই মোরশেদুল আলম, সহিদুল আলম, রাশেদুল আলম, আবদুস সামাদ, ওসমান গণি ও মোহাম্মদ আব্দুলস্নাহ হাসান। এছাড়া আবদুস সামাদের স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, ওসমান গণির স্ত্রী ফারজানা বেগম ও মিশকাত আহমেদ নামে এক ব্যক্তি দেশত্যাগ করতে পারবেন না।
আইনজীবী সালাম জানান, মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন দুদকের উপপরিচালক নূর-ই-আলম।
ওই আবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে এস আলম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে ১ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তারা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। তাই তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের মধ্যে ব্যাংক খাতে লুটপাটের অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়ে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রম্নপ।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় এস আলমের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি করে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। পরে তিনি ও তার ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শরিয়াহভিত্তিক আরও কয়েকটি ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণ নেন।
এসব ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ নামে ও নাম সর্বস্ব কোম্পানি খুলে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ উঠেছে।
ইতোমধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করে শেয়ার লেনদেনও স্থগিত করা হয়েছে। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার সরকারের মালিকানায় নেওয়ার কথা বলেছেন।
এর মধ্যে গত ২৯ আগস্ট এস আলমসহ ৭ আলোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিকানা হস্তান্তর স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরকে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
একদিন বাদে ৩১ আগস্ট সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট জানায়, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তাদের ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য মিলছে।
সাইফুজ্জামান ও নাফিজের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
এদিকে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী রুকমীলা জামান ও পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে সোমবার ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন বলে দুদকের আদালত পরিদর্শক আমির হোসেন জানান।
যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ও তার স্ত্রীর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন দুদকের উপ-পরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল। আদালতে দুদকের পক্ষে শুনারি করেন দুদকের সরকারি কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, 'বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৫টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্যে ৯টি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট অর্জন করেছেন। এছাড়া অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে তিনি বাংলাদেশেও সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।'
দুদকের শঙ্কা, জাবেদ এবং তার স্ত্রী রুকমীলা জামান দেশত্যাগ করতে পারেন। তাই সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়।
অন্যদিকে, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে চৌধুরী নাফিজ সরাফতের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান।
নাফিজ সরাফত কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে দুদকের আবেদনে অভিযোগ করা হয়। আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করের দুদকের সরকারি কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।
পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিএলসির মালিকানাতেও যুক্ত।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত গত এক দশকে হোটেল ব্যবসা, বিদু্যৎ, মোবাইলের টাওয়ার, মিডিয়াসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের অনিয়মে বার বার নাম এলেও পার পেয়ে যান তিনি। ক্ষমতার পালাবদলের পর আরো অনেকের মতো নাফিজ সরাফাতের দুর্নীতির বিষয়েও উদ্যোগী হয় সরকারি সংস্থাগুলো।
ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক গত ১৬ আগস্ট নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর কথা জানায়।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ ২৫ আগস্ট নাফিজ সরাফাত এবং তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
বিভিন্ন অনিয়ম ও শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগে নাফিজ সরাফাতের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিও আলাদাভাবে নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তদন্ত শুরুর ঘোষণা দিয়েছে।