৩০ বছর ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিরাট জনগোষ্ঠী কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণের দাবি জানালেও নানা কারণে বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। উল্টো ঘটা করে নদীর তলদেশে নির্মাণ হয় টানেল। অথচ টানেল নির্মাণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনসাধারণ এবং ব্যবসায়ী মহল থেকে কখনো জোরাল দাবি ছিল না। কালুরঘাট সেতু নির্মাণের পরিবর্তে দ্বিগুণ ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে টানেল। কিন্তু সমীক্ষা অনুযায়ী, টানেল দিয়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ গাড়ি যাতায়াত করার কথা, বাস্তবে চলাচল করছে কম। এতে এই মেগা প্রকল্পে ব্যয় করা অর্থ জলে গেল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। টানেল এখনো সাধারণ জনগণ কিংবা ব্যবসা ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং নানা মহলের বিবেচনায় টানেলটি সাবেক সরকারের আমলে নেওয়া অপরিনামদর্শী প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
টানেল নির্মাণের আগে চীনা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে চালানো হয় সমীক্ষা। ওই সমীক্ষা রিপোর্টে প্রথম বছরেই প্রতিদিন ১৭ হাজার করে গাড়ি চলবে বলে বলা হয়েছিল। বাস্তবে প্রতিদিন গাড়ি চলছে তিন হাজারের চেয়ে কিছু বেশি। যা সমীক্ষা রিপোর্টে দেওয়া তথ্যের চেয়ে অন্তত পাঁচভাগের একভাগ। চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় ব্যয়ের বিপরীতে আয় সমান হতে আরও অন্তত এক দশক অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, সমীক্ষায় বড় ধরনের ভুল থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু টানেল শ্বেতহস্তিতে পরিণত হচ্ছে। মাসে আয় ১২ কোটি টাকা হলেও রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা খাতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। তবে চীনা প্রতিষ্ঠান যে সমীক্ষা দিয়েছিল, এর সমপরিমাণ গাড়ি চলাচল করেনি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরেও। উদ্বোধনের পর ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসের বেশি সময় গাড়ি চলেছে ১৩ লাখ। অথচ সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০ মাসে ৫১ লাখ গাড়ি চলার কথা। সমীক্ষায় দেওয়া রিপোর্ট থেকে গাড়ি চলেছে অন্তত ৩৮ লাখ কম। উদ্বোধনের পর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন তিন হাজার করে গাড়ি চলছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্দোলন পরিস্থিতিতে বন্ধের সময় বাদ দিলে গড় গাড়ি চলাচল সংখ্যা আরও কম হবে।
টানেল কর্তৃপক্ষের টোল ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, উদ্বোধনের পর ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাড়ি চলেছে ১৩ লাখ। অথচ ১০ মাসে ৫১ লাখ গাড়ি চলার কথা। সমীক্ষা দেওয়া রিপোর্ট থেকে গাড়ি চলেছে ৩৮ লাখ কম। গড়ে প্রতিদিন তিন হাজার করে গাড়ি চলছে। সমীক্ষার চেয়ে এত কম গাড়ি কেন চলে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।
সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে 'কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী' শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি করা হয়। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে প্রকল্প কাজ সম্পন্ন করে যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়। টানেল নির্মাণ করে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। এখন টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ব্যয়ের মধ্যে ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকাই চড়া সুদের চীনা ঋণ। চীনের এক্সিম ব্যাংক টানেলের জন্য এই ঋণ প্রদান করে।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী জানান, চীনা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টানেল চালুর প্রথম বছর দৈনিক প্রায় ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলাচল করবে। আগামী বছরের মধ্যে এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি করে যানবাহন চলবে। বার্ষিক হিসাবে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা বছরে এক কোটি ৪০ লাখে উন্নীত হবে। কিন্তু সমীক্ষা রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। গাড়ি চলাচল বৃদ্ধির পরিবর্তে কখনো কমে যায়। কখনো স্বাভাবিক থাকে। চীনা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষার সঙ্গে যানবাহন চলাচল সংখ্যার বাস্তবে মিল না থাকার বিষয়ে জানতে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকৌশলীই কথা বলতে চাননি।
এ ব্যাপারে টানেলের টোল ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, সমীক্ষার চেয়ে গাড়ি বা যানবাহন কেন কম চলছে, তা বলতে পারবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আমার পক্ষে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, 'টানেল করার পরপরই আনোয়ারা প্রান্তে একটি রিং রোড করার কথা ছিল। সেটি না হওয়ায় সমীক্ষায় দৈনিক গাড়ি চলাচলের যে পরিসংখ্যান ধরা হয়, তা হয়তো হচ্ছে না। সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, গাড়ি চলাচল শুরু হতে শিল্প কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি রিং রোডটি করা জরুরি।'
কালুরঘাট সেতুর জন্য তিন দশক ধরে আন্দোলন চলছে। আর টানেলের জন্য দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের কোনো দাবিই ছিল না। এ অবস্থায় কালুরঘাট সেতু না করে টানেল নির্মাণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'টানেলের মতো ব্যয়বহুল মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের আগে দরকার ছিল কম বাজেটের ছোট প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা। এরপর হয়ত টানেল নির্মাণে হাত দেওয়া যেত। কালুরঘাট সেতুর মতো জনদাবির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কাজ শেষ না করেই টানেল নির্মাণ করা ঠিক হলো কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।'
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী শুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'টানেল একটা শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে। ওপারে শিল্পায়ন না হলে টানেল পুরো মাত্রায় ব্যবহার হবে না। কিন্তু চীনা অর্থায়নের এই টানেলের জন্য বছর বছর টাকা পরিশোধ করতেই হবে।'
কোনো ধরনের প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, এ ধরনের প্রশ্ন উঠছে এখন। বিষয়টি সে রকম কিছু কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কালভার্ট সেতু নির্মাণ হয়। দেখা যায়, পরে কালভার্ট পার হওয়ার জন্য রাস্তাই নেই। শেষে দেখা যায়, কালভার্ট বা সেতুটি পড়ে আছে ব্যবহার ছাড়া। টানেলের ক্ষেত্রেও অনেকটা এ রকম হলো কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। টানেল খাতে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এবং প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে, এতে বলা যায়, আমাদের ঘাড়ে একটি বোঝা হয়েই রয়েছে।
এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা কালুরঘাট সেতুর মেয়াদ পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। অন্তত ১০০ বছর পার হয়েছে সেতুর বয়স। তিন দশক ধরে কালুরঘাট সেতুর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি উঠলেও কাজ চলেছে ধীরগতিতে। প্রথমবার করা সমীক্ষা রিপোর্টে উচ্চতাজনিত সমস্যায় নির্মাণকাজ শুরুর আয়োজন ভেস্তে যায়। বর্তমানে নতুন করে সমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার পর একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সেতু নির্মাণের শুরুর দিকে সমীক্ষায় প্রকল্প ব্যয় এক হাজার কোটি টাকার মধ্যে থাকলেও এখন ১১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। নতুন সেতু নির্মাণে কোরিয়ার সঙ্গে ঋণ চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেতুর নির্মাণকাজ কবে হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। সম্প্রতি কালুরঘাট সেতু সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকি।
এ সময় তিনি বলেন, 'সেতুর প্রকল্প প্রস্তাবটি অক্টোবর মাসেই একনেক সভায় উঠবে। একনেকে অনুমোদন হলে সেতু নির্মাণে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হবে।'