বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা অসহনীয় ভোগান্তিতে মানুষ

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

বিশেষ প্রতিনিধি
আশ্বিনের শেষ সময়ের বৃষ্টিতে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীবাসী
আশ্বিনের শেষ সময়ের বৃষ্টিতে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীবাসী। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টি কমে এলেও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশকিছু নিচু এলাকার অলিগলি পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিন সকালে ঝুমবৃষ্টির মধ্যে সড়কে রিকশা, সিএনজি ও প্রাইভেটকারসহ গণপরিবহণগুলো বিভিন্ন সড়কে আটকে যানজটের সৃষ্টি হয়। সরকারি ছুটির দিন হলেও ভারী বর্ষণে বেসরকারি কর্মজীবী, ব্যবসায়ী ও খেটেখাওয়া শ্রমজীবীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে। শনিবার সকালে ঝুমবৃষ্টি নিয়েই দিন শুরু হয় রাজধানীবাসীর। বৃষ্টি অব্যাহত থাকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। ভারী বৃষ্টিতে পথে পথে জমে থাকা পানি, ভাঙাচোরা পথ আর এলোপাতাড়ি চলাচলের কারণে অপ্রতুল গণপরিবহণও কোথাও কোথাও যানজট ভোগান্তির মাত্রা বাড়ায়। বেসরকারি এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মী রিয়াজ উদ্দিন মতিঝিলে যেতে যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে বের হয়েছিলেন সকাল ৮টায়। দোলাইরপাড় হয়ে যাত্রাবাড়ী মোড়ে এসে তিনি গাবতলীগামী যে বাসে উঠেছিলেন, টিকাটুলি পর্যন্ত দুই কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতেই লেগে যায় পুরো এক ঘণ্টা। পায়ে হাঁটলেও এতটুকু পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত আধা ঘণ্টারও কম। বাইরে বৃষ্টি, পুরো সড়কজুড়ে বাস, মোটর সাইকেল রিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের বাহন। ফুটপাতেও পানির কারণে হাঁটা সম্ভব নয়। অগত্যা বাসের মধ্যেই তাকে বসে থাকতে হয়েছে মতিঝিল পৌঁছানো পর্যন্ত। বৃষ্টিতে সড়কজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়ে একই পরিস্থিতি তৈরি হয় মাথার ওপর থাকা যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানমুখী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারেও। রায়েরবাগ থেকে এই ফ্লাইওভারে গুলিস্তান পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যানবাহনের সময় লেগেছে এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের বেশি। সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে গুলিস্তান টোলপস্নাজার আগেই নেমে বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে আরেক বাস ধরতে হয়েছে নারী উদ্যোক্তা নুসরাত জাহানকে। সাধারণ সময় ১৫ মিনিটের এ পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার বেশি সময় নিয়েছে বৃষ্টির কারণে। আশ্বিনের শেষভাগে এসে যে বৃষ্টি ঝরছে, তার যেন বিরাম নেই। কখনো বড় বড় ফোটায়, কখনো আবার ঝিরঝিরে, কিন্তু বর্ষণ চলছেই। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে জমে থাকা পানি দেখা গেছে। পথে পানি জমায় চলার পথ হয়েছে সরু। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় গণপরিবহণ 'ইচ্ছেমতো চলাচল করতে গিয়ে' তৈরি হয়েছে যানজটও। একটানা বৃষ্টিতে টিকাটুলি থেকে মতিঝিলের জীবন বীমা ভবন পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে পানি জমলেও শাপলা চত্বরে জলজট হয়নি। পানির নিচে চলে যাওয়া সড়কের অংশ এড়িয়ে ডান পাশ ধরে ধীরে গতিতে চলাচল করেছে সব যানবাহন। মাটির নিচ দিয়ে বিদু্যৎ সঞ্চালন তার স্থাপনে মতিঝিল অংশের কাজ এখনো চলছে। পানির নিচে থাকা সড়কের কোন জায়গায় গর্ত তা বুঝতে কষ্ট হয় চালকদেরও। ফলে রিকশাগুলোও চলেছে রাস্তার ডানপাশ ধরে। এতেও বাসের গতি কমেছে বলে জানান গাবতলী-যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী গাবতলী লিংক পরিবহণের চালক রহমত উলস্ন্যাহ। তিনি বলেন, 'পানি জমলে তো বোঝা যায় না রাস্তার কোন জায়গায় গর্ত, কোন জায়গায় ভালা। দেহেন রিকশাও ডাইন সাইডে আছে। আমার সামনে রিকশা চলতাছে, ও না সরলে আমি জোরে যাই কেমনে?' একইভাবে বৃষ্টির কারণে সড়কের শৃঙ্খলাও হারিয়েছে বিভিন্ন মোড়ে। রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান পয়েন্টে গণপরিবহণের বড় অংশের গন্তব্য শেষ হয়। সেখানে গাড়ি ঘুরিয়ে যাত্রী তুলতে শুরু করে চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, ডেমরা রুটের বাসগুলো। গুলিস্তান পয়েন্টে নামার পর যাত্রীর চাপ না থাকলে বাসগুলো বাম লেন ধরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। শনিবার ফিরতি যাত্রী না পেয়ে বাসগুলো এভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু গণপরিবহণ গাদাগাদি করে হাঁকডাক করতে থাকে যাত্রী তুলতে। এতে সড়কের সিংহভাগই তাদের দখলে চলে যায়। ফাঁকা অংশ দিয়ে একটি একটি করে গাড়ি পার হয় টোলপস্নাজা দিয়ে। ফ্লাইওভারের ওপরে তিন সারিতে চলা যানবাহন টোলপস্নাজায় নামার সময় একটি সারিতে পরিণত হয়েছে এজন্য। গাড়ির গতি কমে যাওয়ায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর যানবাহনের সারি দীর্ঘ হতে হতে চলে গেছে রায়েরবাগ পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর মিরপুর, কালসী, ইসিবি চত্বর. বংশাল, পুরান ঢাকা, সেগুনবাগিচা, পান্থপথ, তেঁজকুনিপাড়া, তেজতুরি বাজার, গ্রিনরোডসহ বিভিন্ন সড়কেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি। এতে ভোগান্তি পড়তে হয়েছে সেসব সড়কে চলাচল করা মানুষের। সচিবালয়ের সামনে আব্দুল গণি রোড, প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা, নাইটিঙ্গেল মোড়, বংশাল, সেগুনবাগিচা এলাকায় নিম্নাঞ্চলে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। সেগুনবাগিচার রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে হাঁটুপানি। সেখানে কথা হয় রিকশাচালক নীলফামারীর আল আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বৃষ্টিতে সড়ক ডুবে গেলে রিকশা চালানো যায় না। অনেক কষ্ট হয়। আবার গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যাওয়ারও শঙ্কা থাকে। অনেকেই এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আজকে ৫০ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। রাস্তার এক পাশ থেকে ওপাশে গেলেও ২০ টাকা ভাড়া লাগে।' শনিবার পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, বিজয়সরণি, মহাখালীতে গণপরিবহণের ছিল সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক কম। ছিল না যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় নামা বাসের বেপরোয়া চলাচল। এসব সড়কের সিগন্যাল অনায়াসে পার হয়েছে গণপরিবহণ। মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডা রুটে চলাচলকারী বৈশাখী পরিবহণের হেলপার ইমরান বলেন, 'সকাল থেকে বৃষ্টি, এরপর ছুটি, যাত্রী নাই। বৃষ্টির জন্য মানুষ ঘর থেকে বেরুতে পারছে না।' রাজধানীর শ্যামপুর, কদমতলী, দোলাইরপাড়, জুরাইন এলাকার মুরাদপুর, মেডিকেল হাইস্কুল রোড, পোকারবাজার, বৌবাজার, মাদ্রাসা রোড এলাকার বাসিন্দারা জানান, একটু বৃষ্টিতেই পানিতে ডুবে থাকে পুরো এলাকা। গত দুই দিনের ভারী বৃষ্টিতে রাস্তার পানি উপচে দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে। দোকানের অনেক মালামাল ভিজে নষ্ট হয়েছে এবং ঘরে হাঁটুপানি হওয়ায় ঘরের আসবাবপত্র সব ভিজে গেছে। তারা জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর রাস্তা সংস্কার না হওয়ার কারণে ড্রেনগুলে ময়লায় ভরে গেছে। সিটি করপোরেশন ও এলাকার কাউন্সিলরসহ লোকজনের গাফলতির কারণে আমরা পানিতেই বসবাস করছি অনেক বছর। বনশ্রীর বাসিন্দা মাহমুদ পারভেজের অফিস পল্টনে। সকালে বৃষ্টিতে ভিজে পানির মধ্যেই বাসে করে তিনি অফিসে এসেছেন। ভেবেছিলেন বিকালে বাসায় ফেরার সময় ভোগান্তি কম হবে। কিন্তু রওনা দিয়ে দেখলেন কাকরাইল থেকে মালিবাগ এলাকায় অথই পানি। পারভেজ বলেন, 'কাকরাইল পর্যন্ত ঠিকভাবে আসতে পেরেছি। এরপর আর রিকশা, সিএনজি কিছুই যেতে চায় না। আর যারা যেতে চায়, তারা প্রায় তিনগুণ ভাড়া চাচ্ছে। বাসের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে এত ভিড় যে তাতেও ওঠার উপায় নেই। বাধ্য হয়েও বাড়তি ভাড়া গুণে বাসায় ফিরছি।' অসময়ের বৃষ্টি বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সালিম আহসান বলেন, 'বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতিবছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে কৃষি।' আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, 'শনিবার ঢাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা আছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি উত্তর বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। চলতি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে কমতে আসতে পারে।' আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, শনিবার সারাদেশে ১৯৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ১৫৭ মিলিমিটার, চাঁদপুরে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ২৭৭ মিলিমিটার, ঢাকায় ৬৯ মিলিমিটার, নেত্রকোনায় ১৬০ মিলিমিটার, রংপুরে ১৩৮ মিলিমিটার ও মাদারীপুরে ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।