পুরনো সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছে না জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। বছরের পর বছর রোগীদের জিম্মি করে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে আসা ওয়ার্ড ইনচার্জদের সরাতে পারছেন না হাসপাতালের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক। যদিও সাবেক সরকারের পতনের পর সব ওয়ার্ড ইনচার্জ, ডাক্তার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদ পুনর্বণ্টন করে নির্দেশনা জারি করেন পরিচালক। কিন্তু তার এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যায়নি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে।
হাসপাতাল সূত্রের তথ্যানুযায়ী নতুন নির্দেশনা জারির পাঁচ দিন পরই তা আবার পরিবর্তন করতে বাধ্য হন হাসপাতাল পরিচালক। পরবর্তী সময়ে হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের প্রতিবাদে বেশিরভাগ অর্থাৎ ৩০ জন ওয়ার্ড ইনচার্জদের মধ্যে ২২ জন দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন কিন্তু ছয়জন এখনো আগের পদেই বহাল আছেন।
অভিযোগ রয়েছে অতীতের মতো বিভিন্ন মহলের প্রভাব খাটিয়ে তারা আগের পদ ধরে রেখেছেন। খোদ পরিচালকও এই ছয়জনকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছেন। লোভনীয় এই ওয়ার্ড ইনচার্জ পদ বাগে রাখতে টাকার ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটাচ্ছেন।
এদিকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে হাসপাতালের প্রায় ২৮ ওয়ার্ডের ইনচার্জসহ ডাক্তার ও কর্মচারীদের পদ পুনর্বণ্টন করা হয়। যেহেতু সব ওয়ার্ড ইনচার্জদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে তাই তাদের সবারই রদবদল হয়েছে। সবাই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও ওয়ার্ড ইনচার্জ বিলকিস আক্তারসহ ছয়জন এই পদে থাকার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে তদবির শুরু করেন। এদিকে এই বিলকিস বেগমের নেতৃত্বে এসব ওয়ার্ড ইনচার্জরা গত সরকারের সময় প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালে দুর্নীতির ও চুরির ক্ষেত্র গড়ে তোলেন। সে সময় স্বাস্থ্যের সিন্ডিকেট বিশেষ করে স্বাচিব নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে কেউ ৫ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত একই পদে বহাল থেকেছেন।
এর মধ্যে অন্যতম এই বিলকিস। যিনি ৮ বছর ধরে ওয়ার্ড ইনচার্জ পদে বহাল রয়েছেন। ওযুধ চুরিসহ রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন এই বিলকিস ও তার সিন্ডিকেট। জানা গেছে, গোটা হাসপাতালে যত ধরনের অনৈতিক ও অবৈধ লেনদেন হতো তার পুরোটাই হতো বিলকিসের নেতৃত্বে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটালেও এখন নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন বিএনপির লোক হিসেবে।
সাধারণ নার্সদের অভিযোগ, নতুন পরিচালক তাদের দায়িত্ব থেকে সরানোর পর বিলকিসসহ বাকি পাঁচজন টাকার বিনিময়ে পুরনো দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। এ নিয়ে তারা হাসপাতালের ভেতরে বিক্ষোভ ও লিফলেট বিতরণও করেছেন। তাদের প্রচারকৃত লিফলেটে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতালে এই সিন্ডিকেট রোগীদের জিম্মি করে বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা ভোগ করে আসছে। সাধারণ নার্সদের বঞ্চিত করে এরা অর্ধ যুগ ধরে একই পদে বহাল রয়েছে। সর্বশেষ তাদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে তারা হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়ক আড়তি রানী বাড়ৈ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মাইন উদ্দিন জনপ্রতি ১ লাখ টাকার বিনিময়ে বিলকিস আক্তার, ঝর্না বেগম, নুরুন্নাহার, ফাহিমা ভূঞা, শিমকি বিশ্বাস ও হাসিনা বেগমকে আগের ওয়ার্ড ইনচার্জ পদে বহাল রেখেছেন। অবিলম্বে এই বৈষম্যমূলক আদেশ প্রত্যাহার ও ঘুষ নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়েছে।
সাধারণ নার্সদের অভিযোগ, হাসপাতাল প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আদেশ প্রত্যাহার না করে উল্টো তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সিসিইউ ইনচার্জ বিলকিস আক্তারকে রক্ষা করতেই কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি পাঁচজন এই পদে না থাকতে চাইলেও বিলকিসকে আগের পদে রাখতে মোট ছয়জনকে স্বপদেই বহাল রেখেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবদুল অদুদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'কে কোথায় থাকবে তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। সে ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই। আমি যাকে যে পদের জন্য যোগ্য মনে করব সেখানেই থাকবে।' যদিও ১৪ সেপ্টেম্বর যে নির্দেশনা জারি করা হয় তাতে এসব ওয়ার্ড ইনচার্জদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিলকিসের নেতৃত্বে কিছু ওয়ার্ড ইনচার্জ এর বিরোধিতা করেন। এতে হাসপাতালে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিঘ্নিত হয় রোগীদের চিকিৎসাসেবা। অন্যদিকে লোভনীয় এই পদে থাকতে বিভিন্ন মহল থেকে তদবির চালাতে থাকেন বিলকিস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিলকিস আক্তার বলেন, 'আমি সাধারণ নার্সদের অভিযোগ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। হাসপাতাল প্রশাসন এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আমি কোনো টাকার বিনিময়ে এই পদে থাকার চেষ্টা করে নাই।'
এদিকে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারির পর হাসপাতাল পরিচালক যায়যায়দিনকে বলেছিলেন, 'দ্রম্নতই নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ম মেনে নতুন ইনচার্জরা দায়িত্ব নেবেন। পুরনো ইনচার্জরা তাদের বণ্টনকৃত দায়িত্বে ফিরবেন।' এরপর পাঁচ দিন কেটে গেলেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি। পরবর্তীকালে নানামুখী চাপে ১৯ সেপ্টেম্বর পরিচালক নতুন আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যেখানে বিলকিস আক্তারসহ মোট ছয়জনকে আগের পদে বহাল রেখে দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করেন।