বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, যারা এই সমাজের দুশমন তারাই শিল্প ধ্বংস করতে চায়। তারা শ্রমিকদের আবেগকে উসকে দিয়ে রাস্তায় নামায়। তারা বলে শ্রমিকরা ঘরে বসে বেনিফিট পাবে। কিছু কিছু মালিক আছেন তারা চায় শ্রমিকদের ঘাম নয়, পারলে তাদের রক্ত চুষে নিতে চায়, এটা অন্যায়।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে শহরের রাজবাড়ী মাঠে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
জামায়াতের আমির বলেন, 'শিল্প যারা বাঁচাবে তাদের বাঁচতে দিন। আপনি তাদের সম্মান করবেন, তারা সমস্ত শক্তি উজাড় করে আপনাকে সব কিছু বিলিয়ে যাবে। শিল্পের উন্নতি হবে, তাদেরও উন্নতি হবে। আমরা ঐরকম বৈষম্যহীন একটা সমাজ চাই। আমরা এমন একটা সমাজ চাই- যেই সমাজে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর চারটি অধিকার (খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্য এবং সুশিক্ষা) সরকার তাকে দিতে বাধ্য থাকবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশে মতলববাজরা মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে রাখে। উদ্যোক্তা এবং মালিক যদি না থাকে শ্রমিকরা কোথায় কাজ করবে। শিল্প যদি না বাঁচে কর্মসংস্থান কোথায় হবে। আমরা চাই ব্যবসায়ীরা তার জায়গায় বসে ব্যবসা করুক, কোনো দুর্বৃত্তের সাহস হবে না তার কাছে চাঁদা চাওয়ার। বাজারে স্বস্তি থাকবে, সহনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে যাতে প্রতিটি মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী স্বস্তির সাথে বসবাস করতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা এমন হবে, সে ঘরের মধ্যে দরজা খোলা বা বন্ধ হোক রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমাবে, কোনো দুর্বৃত্ত তার সম্পদ বা ইজ্জত লুটে নেওয়ার সাহস করবে না। আমরা এমন একটা সমাজ চাই।'
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, 'এই দেশ দফায় দফায় রক্তের বিনিময়ে বারবার মুক্তির জন্য আহাজারি করেছে '৪৭, '৭১ আবার ২০২৪ সালে। কোনো জাতি তাদের নিজেদের মুখ্য স্বাধীন অধিকারের জন্য এত রক্ত দিয়েছে কি-না আমি জানি না। সমানতালে যুদ্ধ করেছে নারী পুরুষ এবং শিশুরাও।'
তিনি আরও বলেন, 'সম্প্রতি নতুন যে স্বাধীনতা বাংলাদেশের মানুষ লাভ করেছে তার মাত্র দুই দিন আগে এক মা তার দেড় মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে রাস্তায় চলে এসেছেন। পুলিশের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। সাংবাদিকরা বলেছিল মা তুমি সরে যাও। তোমার এই কচি বাচ্চা নিয়ে তুমি এখানে থেকো না। সে বলেছে আমার তো বড় বাচ্চা নাই। আমার পরিবারের কি কেউ শহীদ হবে না? আমি এই বাচ্চা নিয়ে শহীদ হওয়ার জন্য এখানে এসেছি। আমি আমার এবং আমার বাচ্চার শাহাদাতের বিনময়ে জাতি মুক্ত হয়েছে স্বাধীন হয়েছে আমি দেখতে চাই। যে জাতির মনে এ ধরনের মায়া সৃষ্টি করেছেন আমরা দোয়া করি আলস্নাহতায়ালা সেই জাতির মায়েদের পেট থেকে সন্তান সৃষ্টি না করে যেন যোদ্ধা সৃষ্টি করে দেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'গত আগত এবং অনাগত দেখে যেন আমাদের শিক্ষা হয়। যারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জনগণের অর্থে কিনা অস্ত্র এবং বুলেট জনগণের বুকে ধরার দুঃসাহস করবে এমন কেনো সন্ত্রাসী আর দেখতে চাই না। পুরো বাংলাদেশকে এক করতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাতকে এক করতে হবে। বিশ্বকে জানান দিতে হবে দেশ এবং জাতির স্বার্থে আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। যত বিভাজন রেখা তৈরি করা হয়েছিল সবগুলোকে আমরা পায়ের নিচে ফেলে দিয়েছি। আর আমরা কাউকে এই জাতিকে বিভক্ত করার সুযোগ করে দিব না। দলের, ধর্মের ও গোষ্ঠীর ভিত্তিতে আমরা জাতিকে আর ভাগ করার সুযোগ দিব না। জাতিকে তারাই ভাগ করে, যারা জাতির দুশমন। যারা জাতির বন্ধু, তারা জাতিকে কখনো ভাগ এবং বিভক্ত করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে আমরা আপসহীন।'
জামায়েত আমির বলেন, 'জাতির সাথে গাদ্দারি করলে, সেবক হয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে মালিক বনে গেলে কি পরিণতি হয়। দেশ থেকে যারা পালিয়েছেন এটা থেকে আমি ও আমরা এবং দেশবাসী যেন শিক্ষা নেই। আমরা আজ হোক, কাল হোক, নিকটে হোক, ভবিষ্যতে হোক- কখনোই আর কোনো সন্ত্রাসী সরকার দেখতে চাই না।'
'আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে জানিয়ে দিব, তোমরা অতীতে যা করেছো এ জাতি আর তোমাদের তা করতে দেবে না। আমরা জানিয়ে দিব এখন থেকে বাংলাদেশের মানুষ কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলবে। আমরা চাই এমন একটা দেশ হবে, যেই দেশে বৈষম্য থাকবে না।'
প্রধান অতিথি বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এমন একটা সমাজ প্রয়োজন যে সমাজে শিক্ষিত মানুষগুলো কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকা জাতির কাছ থেকে লুটপাট করবে না। আমরা কোনো শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদকে আদালতের বিচারক হতে দেখতে চাই না। কোনো দুর্বৃত্তকে আদালতের চেয়ারে দেখতে চাই না। একজন সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রের সেবক, তিনি দল গোষ্ঠী বা ব্যক্তির সেবক না। আমরা এমন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আগামীতে দেখতে চাই না যাদের বাধ্য করা হবে রাষ্ট্র, জনগণ বাদ দিয়ে গোষ্ঠীর পূজা করার জন্য। এমন একটা দেশ আমাদের সকলের কামনা। সেই দেশটা আমাদেরই গড়তে হবে, ইনশাআলস্নাহ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ।
জামায়াতের আমির বলেন, 'বাংলাদেশে সাড়ে ১৫ বছর জামায়াতে ইসলামীকে ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন করা হয়েছে। ১১ জন শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। জুলুম করে বিচারিক হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। সর্বশেষ দুঃখজনক ঘটনার শিকার হয়েছেন আলস্নামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। যাদের হত্যা করা হয়েছে, আমরা দেখতে চাই এই জগতে সেই হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। হত্যার পরিকল্পনাকারী, মাস্টারমাইন্ড, হত্যা বাস্তবায়নকারী, আদালতে বসে যারা দুষ্ট রায় দিয়েছেন, মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছেন, তদন্ত করতে গিয়ে যারা নাটক সাজিয়েছেন এদের কেউ যেন সেই অপরাধ থেকে রেহাই না পায়। তারা গোটা জাতিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস দেশপ্রেমিক অফিসারদের ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিডিআর বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে। নিরীহ মানুষ যারা জেলে বন্দি আছে তাদের সবার মুক্তি চাই। আমরা বলেছিলাম প্রতিশোধ নিব না, আইন হাতে তুলে নিব না। আমাদের সহকর্মীরা চরম ধৈর্য ধারণ করেছে। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের সাথে কি আচরণটা করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে চতুর্দিকে আলো নিভিয়ে তারা ব্রাশফায়ার করে কতজনকে যে হত্যা করেছে আলস্নাহ ভালো জানে। তাদের লাশটিও পাওয়া যায়নি। দুষ্ট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ২৪-এর পতনের মাত্র চার দিন আগে বললো বাড়াবাড়ি করবেন না, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ভুলে যাবেন না। রাত ১২টার পর আমরা সব কয়টাকে সাফ করে দিয়েছি।'
শহীদ পরিবারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'যারা শহীদ হয়েছে তারা চাকরি পাওয়ার জন্য বা কারো সহযোগিতার জন্য লড়াই করে নাই। তারা আমাদের অহংকার, মর্যাদার এবং সম্মানের পাত্র। তারা নিঃস্বার্থ লড়াই করেছে জাতিকে সম্মানিত করার জন্য। জাতির দায়িত্ব এখন তাদের পরিবারকে সম্মানিত করা। এটা করতে হবে, এর বিকল্প নেই। সরকারের কাছে দাবি জানাবো তাদের সঠিক স্বীকৃতিটা যেন দেওয়া হয়। প্রতিটা শহীদ পরিবার থেকে কমপক্ষে একজনকে যেন সরকার সম্মানজনক চাকরির ব্যবস্থা করে। লড়াই করে যারা আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে তাদেরও যেন সম্মানজনক চাকরি দেওয়া হয়। তারা যেন আজীবন কারো করুণার পাত্র হয়ে না থাকে।'
জবাবদিহিতা ও বিচারবিভাগ নিয়ে বলেন, 'এমন একটা সমাজ প্রয়োজন যে সমাজে শিক্ষিতরা কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকা জাতির কাছ থেকে লুণ্ঠন করবে না। কলম হাতে নিয়ে তার কলিজাটা থর থর করে কাঁপবে এই ভেবে যে আখেরাতে আলস্নাহর কাছে জবাব দিতে হবে। আমরা শপথবদ্ধ কোনো রাজনীতি ব্যক্তিকে আদালতে বিচারক হিসেবে দেখতে চাই না। একজন সরকারি কর্মকর্তা তিনি রাষ্ট্রের সেবক। কোনো দল বা ব্যক্তির সেবা করতে পারে না।'
দলীয় নির্যাতনের বিষয়ে জামায়েত আমির বলেন, 'আমরা বলেছিলাম কারো প্রতি অবিচার করবো না, কোনো প্রতিশোধ নেবো না। সেটা আমরা করিনি। আমাদের ওপর গত ১৫ বছর যে অত্যাচার হয়েছে তা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নির্যাতন। তারপরও আমাদের নেতাকর্মীরা ৫ আগস্টের পর কোথাও কারও ব্যবসা বা বাড়িতে হামলা করেনি।
গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক অধ্যাপক মুহা. জামাল উদদীনের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উলস্নাহ। বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ড. খলিলুর রহমান, ঢাকা উত্তর অঞ্চল টিমের সদস্য আবুল হাসেম খান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন, গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির ড. জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির মুহাম্মদ খায়রুল হাসান, মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাউদ্দিন আইউবী প্রমুখ।