বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন 'বাংলার জ্যোতি' নামে যে জাহাজটিতে আগুন লেগেছিল, সেটি ৩৭ বছরের পুরনো। অনেক আগেই এটি স্ক্র্যাপিং করার সিদ্ধান্ত ছিল বিএসসির। অনেকটা ত্রম্নটিপূর্ণ থাকার পরও ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। জাহাজের ফোর পিক স্টোরে অতিরিক্ত পরিমাণে দাহ্য গ্যাস জমা হওয়ায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এ ছাড়া আগুন নির্বাপণের পর জাহাজটি ভেড়ানোর সময় ডলফিন জেটি-৭ এর পশ্চিম পাশের ফেন্ডার সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা যায়, অগ্নিনির্বাপনের পরপরই ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফ হাসনাতকে আহ্বায়ক, সংস্থাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (পস্ন্যানিং ও শিপিং) মো. মোস্তাফিজার রহমানকে সদস্য সচিব, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার, বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. জাহিদ হোসাইন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন), পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আসিফ মালিক ও যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপককে (অপারেশন) সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিপিসি।
তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, আবুধাবি থেকে আমদানি করা প্রায় ৯৮ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন মারবান ক্রুড অয়েলবাহী মাদারভ্যাসেল 'ওমেরা ল্যাগাসি' ১৭ সেপ্টেম্বর কুতুবদিয়া বহির্নোঙ্গরে আগমন করে। ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে জাহাজটি থেকে ক্রুড অয়েল খালাসের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল খালাসের পরমহূর্তে জাহাজটির ফোর পিক স্টোরে (জাহাজের রশি, নোঙ্গর, স্পেয়ার পার্টস রাখার স্থান) অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফোর পিক স্টোরে ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন রুটিন কাজ করতে গেলে সেখানে জমে থাকা অতিরিক্ত দাহ্য গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাজটিতে থাকা ১০ হাজার ৯১৬ দশমিট ৮৪৬ মেট্রিক টন কার্গো নিরাপদে রয়েছে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করতে প্রায় ২২ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হবে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করা হলে জাহাজটি মেরামত বা সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরিয়ে নেওয়া হবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) সূত্রে উলেস্নখ করা হয়, জাহাজে থাকা অবশিষ্ট কার্গো খালাসের লক্ষ্যে জাহাজের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি পরিদর্শন করবেন। জাহাজটি নিরাপদ হিসেবে প্রত্যয়িত হলে জাহাজের অন্য মেশিনারিজ ঠিক থাকা সাপেক্ষে কার্গো খালাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এম.টি. বাংলার জ্যোতি ও এম.টি. বাংলার সৌরভ জাহাজ দুটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত। জাহাজ দুটির আয়ুষ্কাল প্রায় ৩৭ (সাঁইত্রিশ) বছর। এই দুটি জাহাজের বিকল্প জাহাজ দেশের অভ্যন্তরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের জাহাজের বিকল্প না থাকায় ওই জাহাজ ২টি যথাযথ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে চালু রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া তদন্ত কমিটির পক্ষে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও বিদ্যমান লাইটার জাহাজ দুটির ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠনের জন্য বিএসসিকে অনুরোধ করা যেতে পারে। বিএসসির লাইটার জাহাজ এম.টি. বাংলার জ্যোতি ও এম.টি. বাংলার সৌরভ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল লাইটারিং কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমদানি করা ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণে (ওএন্ডএম) ঠিকাদার নিয়োগ দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে নিরাপদে ক্রুড অয়েল খালাস করা সম্ভব হবে। এসপিএমের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওঅ্যান্ডএম ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজকে কার্যকরভাবে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে কি না বা সম্ভাব্য বিকল্পের বিষয়ে বিএসসির মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে। জেটিসমূহে থাকা অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাদি আরও আধুনিকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
জানা যায়, ১২-১৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে সরকার। যার মাদার ভ্যাসেল পার্ট ও লাইটারিং করে বিএসসি। বিএসসির বহরে বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি নামে দুটি লাইটারিং জাহাজ আছে। সৌরভের ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ায় এমনও হয়েছে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা খরচ একটি টাগ ব্যবহার করেও লাইটারিং করা হয়।
বিএসসির সূত্রে জানা যায়, বিএসসির বহরে বর্তমানে ৭টি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি সমুদ্রগামী, যা বহির্বিশ্বের পণ্য পরিবহণে কাজ করে। বাকি দুটি লাইটার জাহাজ। লাইটার জাহাজ দুটি ১৯৮৭ সালে ডেনমার্কে তৈরি করা হয়। অপারেশনের শুরু থেকে লাইটারেজ দুটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জন্য আমদানি করা ক্রুড অয়েল বন্দরের বহির্নোঙর থেকে খালাস করে সেগুলো ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নিয়ে আসে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত হয়। ১৯৮৮ সালে জাহাজটি নৌবাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটির মালিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। পুরনো হওয়ায় জাহাজটি ইতোমধ্যে স্ক্র্যাপিং করারও সিদ্ধান্ত নেয় বিএসসি। দুর্ঘটনার আগেও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিপিসি তাদের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বাণিজ্যিকভাবে চালু না করায় অনেকটা বাধ্য হয়েই এমটি বাংলার জ্যোতিকে ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করতে হয়।
একটি জাহাজের লাইফটাইম সর্বোচ্চ ২৫ বছর ধরা হলেও ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজ দিয়ে তেল পরিবহণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, 'জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছিল বলে আমরা মেরামত করে বাংলার জ্যোতিসহ লাইটার জাহাজ দুটি সচল রাখছিলাম। পুরনো হওয়ায় প্রতিদিনই আমাদের ওয়ার্কশপ থেকে লোকজন পাঠানো হয় জাহাজে। সমুদ্রগামী ৫টি জাহাজে যতটা ইফোর্ট দেওয়া হয় তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয় পুরনো লাইটার জাহাজ দুটিতে। ১৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণ সক্ষমতার বাংলার জ্যোতি জাহাজটিতে ১১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল ছিল। এর মধ্যে কিছু তেল খালাস হয়েছিল। যদি জাহাজে থাকা তেলে আগুন লেগে যেত তাহলে ভয়াবহ হতো। জাহাজে ফাটল দেখা দিলে বিপদ হতো। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটলে আন্তর্জাতিক ইসু্য হয়ে যেতে পারত। আগুন নেভানোর পর দুর্ঘটনাস্থলে গ্যাস আছে কিনা আমরা দেখেছি। বৈদু্যতিক সরঞ্জাম আইসোলেটেড করে রাখা হয়েছে। তেল খালাসের পর জাহাজটি টাগ বোটের সহায়তায় ডকে নেওয়া হবে।'
কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, 'জাহাজের প্রি-ডকিং শিডিউল থাকে। কিন্তু এই জাহাজের ক্ষেত্রে কোনো ডকিং শিডিউল ছিল না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাহাজটি আমরা ব্যবহার করছি। কারণ এসপিএম চালু হলে জাহাজ দুটির কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আবার এখন এসপিএম চালু না হলেও বিপিসির ক্রুড লাইটারিং করার জন্য দুটি জাহাজ কিনতে হলে অন্তত ৬শ' থেকে ৭শ' কোটি টাকা লাগবে। নতুন জাহাজ কিনলেও এসপিএম চালু হলে তাও কাজে আসবে না।'
বিএসসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'অতীতকাল থেকে জাহাজের মাস্টাররা নিজেদের সন্তান মনে করে জাহাজকে। দুর্ঘটনার সময়ও তারা জাহাজ ছেড়ে নামতে চান না। মাস্টার সালাউদ্দিন অগ্নিকান্ডের মধ্যেও দাঁড়িয়ে ছিলেন জাহাজে। আমরা তাকে জোর করে নামিয়ে এনেছি। আমরা কখনো চাই না, কেউ হতাহত হোক। জানের ওপর কিছু নেই।'
উলেস্নখ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বহির্নোঙর থেকে প্রায় ১০ হাজার টন ক্রুড নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে আসে এমটি বাংলার জ্যোতি। জেটিতে বার্থিং করা অবস্থায় সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। আগুনে তিনজনের মৃতু্য হয়।