মহালয়ায় দুর্গার আবাহনে সূচনা দেবীপক্ষের
প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
দরজায় কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হলো দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনা। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে সূচনা হলো দেবীপক্ষের। বুধবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মন্দিরে-মন্ডপে উদযাপিত হয়েছে মহালয়া অনুষ্ঠানের। এই দিন ভোরে ভক্তরা মন্দিরে জড়ো হয়ে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবীকে মর্ত্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ ছাড়া ছিল মঙ্গলঘট স্থাপন, চন্ডীপূজা, ঢাক-কাঁসা ও শঙ্খ বাজিয়ে দেবীকে মর্ত্যে আহ্বান ও পিতৃতর্পণ। ছিল মহিষাসুর বধসহ নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।
বুধবার ভোর ৬টায় রাজধানীর শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে এবং শ্রী শ্রী চন্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহালয়া অনুষ্ঠান। এরপরই সেখানে দেবীর আরাধনা করা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন দেবীভক্তরা। পূজা উদযাপন পরিষদের শিল্পীরা সঙ্গীত ও 'মহিষাসুরমর্দিনী' নৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নেন। এরপর ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
এ ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠমন্দির, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজামন্ডপ, রমনা কালীমন্দির, সিদ্ধেশ্বরী পূজামন্ডপসহ রাজধানী ও সারাদেশের বিভিন্ন মন্দির ও মন্ডপেও চন্ডীপাঠ, দেবীর আবাহনী সঙ্গীত, ধর্মীয় আলোচনা সভা ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। আশ্বিন মাসের এই শুক্ল পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় 'কাত্যায়নী মুনির কন্যা' রূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।
মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস চন্দ্র বলেন, 'চন্ডীপাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্ব শেষে কল্পারম্ভ আবাহনে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন, ঘট স্থাপন, পূজার্চনা, আরাধনা, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠিত হয়।'
ঢাকেশ্বরীতে মহালয়ার দ্বিতীয় পর্বের মূল আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ১০টায়। এই পর্বে ভক্তরা পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় তিল তর্পণ করেন। পরে মহালয়ার ঘট স্থাপন ও বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মহালয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো তর্পণ শ্রাদ্ধ। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোক বা যমলোকে বাস করেন। আর এই পিতৃলোকের অবস্থান স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে। পিতৃলোকের শাসক মৃতু্য দেবতা যম। তিনি সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। এরপর পরের প্রজন্মের একজনের মৃতু্য হলে আগের প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন। একই সঙ্গে পরমাত্মায় বা ঈশ্বরে বিলীন হন।
এ কারণে মহালয়ায় হিন্দুরা তাদের পূর্বে মারা যাওয়া তিন প্রজন্মের ব্যক্তিদের স্মরণ বা তর্পণ করে থাকেন। এদিন শ্রদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি দেন।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসা শিপ্রা রানী বলেন, 'অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের মহালয়ার অনুভূতি ভিন্ন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এই প্রথম মহালয়ার অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণ। প্রথমেই চন্ডীপাঠ এবং তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল আড়ম্বরপূর্ণ। 'মহিষাসুরমর্দিনী' প্রদর্শনী ছিল চোখ ধাঁধানো। সব মিলিয়ে বেশ আনন্দপূর্ণ একটি সকাল কাটল।'
এদিন সকালে মন্দির প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পাশাপাশি দায়িত্বে ছিলেন সেনা সদস্যরাও।
সরকারি হিসাবে এ বছর সারাদেশে এবার ৩২ হাজার ৬৬৬টি মন্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন করা হবে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। ৫ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে সেদিন। পরদিন ১০ অক্টোবর সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আয়োজন। এরপর অষ্টমী ও নবমী শেষে ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী এবার দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন দোলায় চেপে, ফিরবেন গজের পিঠে চড়ে। শাস্ত্র বলছে, 'রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ। দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে।'
শাস্ত্র বলছে, দোলা অর্থাৎ পালকিতে আগমন বা গমনের ফল হলো- 'দোলায়াং মকরং ভবেৎ'; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ ও অতিমৃতু্যর ইঙ্গিত। আর গজ বা হাতিতে গমন-আগমনের ফল হয়- 'গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা'; অর্থাৎ পৃথিবী শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, অশুভ শক্তির বিনাশে ঘটবে সমৃদ্ধি।