আগামী নভেম্বরে যশোর থেকে নড়াইল হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় রেল চলাচল শুরুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। অক্টোবরেই এই কাজ সমাপ্ত হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তবে যশোরের ট্রেনগুলো শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের পদ্মবিলা স্টেশন থেকে যাত্রার খবরে হতাশ বৃহত্তর যশোরের তিন জেলার বাসিন্দারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে আশায় বুক বেঁধেছিল যশোরবাসী, সেই আশা-উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ছে। রেলপথ বিভাগের সিদ্ধান্তের কারণে বৃহত্তর যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষের সেই স্বপ্ন ম্স্নান হতে বসেছে। ট্রেনে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যশোর সদরের পদ্মবিলা রেলস্টেশনটি। যার অবস্থান যশোর শহরের মূল স্টেশন থেকে ১৫, বেনাপোল ৩৫, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর স্টেশন থেকে ৪৫ কিলোমিটার এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্টেশন থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে। এই অঞ্চলের মানুষকে ট্রেনে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যেতে হলে ১৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মবিলা স্টেশনে যেতে হবে। যা এই অঞ্চলের যাত্রীদের সময় ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে। এ কারণে এই ট্রেনের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। ফলে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী রেলযোগাযোগের প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। ভোগান্তি লাঘব, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে পদ্মা সেতুর রুটের সঙ্গে বেনাপোল-যশোর, দর্শনা-কোটচাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনের সংযুক্ত করার দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলছে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের রেলপথের কাজ। পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের বাকি থাকা এ কাজ শেষ হতে যাচ্ছে অক্টোবরেই। এরইমধ্যে টেস্ট অ্যান্ড কমিশনিং করে রেললাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। এই অংশের অগ্রগতি এখন ৯৭ দশমিক ছয় শূন্য শতাংশ। আর ভাঙ্গা জংশনের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। আধুনিক এই জংশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যশোরের লাইন। প্রকল্পটির ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৯৭ দশমিক সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ছয় চার শতাংশ। আর সার্বিক অগ্রগতি ৯৮ দশমিক এক ছয় শতাংশ।
আফজাল হোসেন বলেন, ভাঙ্গা থেকে যশোর নতুন রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চালু হবে নভেম্বরে। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার এই প্রকল্পের প্রায় এক হাজার ৬২১ কোটি টাকা সাশ্রয়েরও আশা করা হচ্ছে। এদিকে নতুন পথে রেললাইন চালুর খবরে খুশি মানুষ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদারকিতে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি সিঙ্গেল লাইনের ১৬৬ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মাণ করে।
এদিকে পদ্মা সেতুর রেলওয়ে যোগাযোগের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বৃহত্তর যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষের। যশোর-ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর-চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে করে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যাওয়া আসায় সময় লাগে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের খবরে এই অঞ্চলের মানুষেরা উচ্ছ্বসিত হলেও, এখন তাদের কাছে হতাশার আরেক নাম পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ সবচেয়ে বেশি উপকারভোগী হতো বৃহত্তর যশোরের যাত্রীরা। অথচ পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পে বৃহত্তর যশোর জেলাকে বঞ্চিত করা হয়েছে দাবি করছেন বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।
সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, যমুনা সেতু দিয়ে বর্তমানে যশোরবাসী যশোর, কোটচাঁদপুর ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ৩টি ট্রেন পাচ্ছেন। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প চালু হলে এ রুটে মাত্র একটা ট্রেন পাবে। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষ চরমভাবে বঞ্চিত হবে। পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নেই থেকে যাবে। তাই বেনাপোল-যশোর ঢাকা রুটে ২টা ট্রেন ও দর্শনা-যশোর-ঢাকা রুটে ২টা ট্রেন চালু এবং খুলনা থেকে যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা রুটের ট্রেনগুলো বহাল রাখতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন সময়সূচি এমন করতে হবে যাতে যশোর থেকে ঢাকায় প্রতিদিন অফিস করতে পারে। আন্তঃনগর ট্রেনে সুলভ (সাধারণ) বগি ও কৃষি পণ্য-সবজি-ফুল-ফল-মাছ বহনের জন্য 'ভ্যান্ডার' (মালবাহী বগী) যুক্ত করতে হবে।
এ বিষয়ে যশোর আরএন রোডের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী নুরুজজ্জামান বলেন, 'পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন যাত্রা আমাদের যশোর অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে। সকালে যেয়ে কাজ শেষ করে বিকালে বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু বৃহত্তর যশোরের যাত্রীদের স্টেশন করেছে পদ্মবিলাতে। এত দূর থেকে পদ্মবিলা গিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা সবকিছুর জন্য বিড়ম্বনা।'
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, 'বৃহত্তর যশোরবাসীর জন্য পদ্মা সেতু হয়ে যে ট্রেনগুলো চলাচল করবে, সেটির স্টেশন করা হয়েছে পদ্মবিলাতে। এটি অপরিকল্পিত। ওখানে স্টেশন করাতে কোনো যাত্রীই পাবে না। যাত্রী পেতে হলে বেনাপোলে স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ট্রেনগুলো। কেননা প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার যাত্রী ভারতে যাওয়া-আসা করে। এর সিংহভাগ যাত্রীরা ঢাকা থেকে আসে বা যায়। ফলে বেনাপোল স্টেশনের সঙ্গে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চালু হলে যাত্রী পাবে এবং দুই দেশের যাত্রীদের যে কষ্ট সেটা লাঘব হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা রেল বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। যাতে যশোর-বেনাপোল-যশোর স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।'
এ বিষয়ে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক জিলস্নুর রহমান ভিটু বলেন, 'পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগটা চালু হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বৃহত্তর যশোরের মানুষ। কিন্তু রেল বিভাগের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে সেই রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হবে বৃহত্তর যশোরের তিনটি জেলার মানুষ। খুলনা-যশোরের বন্দবিলা-ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার যে রুট করা হয়েছে, সেটা যশোরবাসীর কোনো উপকার আসবে না। তিনটি জেলার যাত্রীরা পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকাতে যেতে হলে পদ্মবিলাতে যেতে হবে। সেটা এই অঞ্চলের যাত্রীদের জন্য অনেক বিড়ম্বনার। পদ্মা সেতুর কাঙ্ক্ষিত সুবিধা দিতে হলে এই অঞ্চলে যতগুলো স্টেশন আছে যেমন দর্শনা-কোটচাঁদপুর, বেনাপোল-যশোর স্টেশনে দুইটা করে মোট চারটা ট্রেন দিতে হবে। তা না হলে পদ্মা সেতুর রেলের সুবিধা পাবে না।'
খুলনা রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার মো. মাসুদ রানা জানান, 'নতুন রেললিংক চালু হবে। খুলনা থেকে সব ট্রেনই পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাবে। এ জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। নতুন করে টিকিটের বুথ বাড়ানো হচ্ছে। অন্যান্য প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি।'