সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, শ্রমজীবীরা তার ন্যায্য হিস্যা পাননি। কারণ হিসেবে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, শ্রমিকদের মজুরি যথোপযুক্ত নয়। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় বাসস্থান, মাতৃত্বকালীন সুবিধাসহ যেসব ব্যবস্থা থাকার কথা, সেগুলোও যথেষ্ট নয়।
শ্রমিকদের কল্যাণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেই বলেও অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতারা। যেমন ভবিষ্য তহবিলসহ সামাজিক সুরক্ষার অন্য যেসব উপকরণ, সেগুলো যথাযথ নয়। আইনে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকলেও তারা নির্বিঘ্নে তা করতে পারছেন না। সেই সঙ্গে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো চালুর যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটছে; বড় বড় কায়েমি স্বার্থের প্রভাবে তা হচ্ছে।
সোমবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন
কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বাংলাদেশে এখন শিল্পক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ ছাড়া শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে দেশের শ্রম আইনের সামঞ্জস্য না হওয়ায় শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে উলেস্নখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠকে শ্রমিক নেতারা নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শ্রমিকদের এসব আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয় আমলে নেওয়া হবে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কমিটি অনুসন্ধান করে কী পেল-এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রথমে কমিটির কাজের পরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। সদস্যরা কে কোন কাজ করবেন, তা বণ্টন করা হয়েছে। ১১ জন মানুষ ২৩টি বিষয়ে কাজ করছেন। কে কোন বিষয়ে কাজ করছেন, তা প্রধান উপদেষ্টাকে জানানোর পর সাংবাদিকদের জানানো হবে।
এ ছাড়া সরকারি পরিসংখ্যানের যথার্থতা যাচাইয়ে তথ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, যেমন আজ (সোমবার) শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা হলো। খাতওয়ারি আরও আলোচনা হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সাহায্যদাতাদের সঙ্গেও আলোচনা হবে। এর মধ্য দিয়ে যেসব তথ্য আসছে, এখন তা আত্মস্থ করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেবপ্রিয় বলেন, 'আপনারা জেনে খুশি হবেন, আমরা ঢাকার বাইরে যাব। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে টাউন হলে বৈঠক হবে। এ সবকিছু সংশ্লেষ করে আমরা খসড়া তৈরি করব। তিন মাসের যে সূচি আমাদের দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে এসব করা হবে।'
শ্বেতপত্র কমিটি কি অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক করছে, নাকি অনিয়ম-দুর্নীতির কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গবেষণাপদ্ধতির মূল বিষয় হলো- কোনো একটি উৎসের প্রতি আস্থা না রেখে আরেকটি উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা। যেসব প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। এসব তথ্য যারা ব্যবহার করে, তারা কী সমস্যায় পড়েছে, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। এরপর এর সঙ্গে নতুন তথ্য-উপাত্ত যুক্ত হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, 'মোদ্দাকথা হলো, বহুবিধ পদ্ধতির ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা বহুবিধ পদ্ধতির একটি অংশমাত্র। এ সবকিছুর সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হব। তখন সাংবাদিকদের তা জানানো হবে।'
তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কমিটি আশাবাদী।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে গত ২৮ আগস্ট দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
শ্বেতপত্রে মোট ছয়টি বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ), ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের বিষয়াদি থাকবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎপাদন, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ এবং বাহ্যিক ভারসাম্যের মধ্যে থাকবে রপ্তানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়নের প্রভাব ও ঋণ।
শ্বেতপত্রে সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি খাতওয়ারি পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করা হবে। যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, ব্যাংকিং, কর আহরণ, অর্থ পাচার, মেগা প্রকল্প, দারিদ্র্য ও বৈষম্য। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যদি কোনো খাতের প্রতিবেদন তৈরি হয়ে যায়, তাহলে তা অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশ করা হবে।