উত্তরে বন্যা : ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে বাসিন্দাদের
পাঁচ জেলায় পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ তিস্তা ও ধরলা তীরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ধরলা নদীর তীব্রভাঙনে কুড়িগ্রামের উলিপুরে অন্তত ৩০ পরিবারের বসতিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব জেলার নদনদীর কূলঘেঁষা চর ও চরদ্বীপসহ আশপাশের লোকালয়ের রাস্তাঘাট ডুবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথেও। পানি বেড়ে যাওয়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদনদী। পানির চাপ বেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোও ঝুঁকিতে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। ভাঙন-আতঙ্কেও দিন কাটছে নদীপাড়ের হাজারও মানুষের।
এদিকে রংপুর বিভাগের তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি কমছে এবং ধরলা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে ও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, বৃষ্টি না হলে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি কমে আগামী ৩ দিনে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যদিকে আজ
মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে টানা ৪ দিন বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সোমবার দুপুরে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, 'রোববার তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, সেটি আজ (সোমবার) ডালিয়া এবং কাউনিয়া দুই পয়েন্টেই নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।'
কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, 'উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে এসেছে। সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উজানে পদ্মার পানি বাড়লেও সেটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।'
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাতে বুলেটিনে বলা হয়, রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতিভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে এসেছে। ফলে আগামী ৩ দিন তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি কমতে পারে। তাতে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীসংলগ্ন চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
বুলেটিনে আরও বলা হয়েছে, রংপুর বিভাগের অন্য প্রধান নদী- আত্রাই, পুনর্ভবা, করতোয়া, টাঙ্গন ও যমুনেশ্বরী নদীর পানি কমছে। ইছামতী-যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। অন্যদিকে ঘাঘট নদীর পানি সমতল বাড়ছে, তবে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুর বিভাগের এসব নদীর পানি আগামী তিনদিন কমতে পারে।
রংপুর বিভাগের ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার ভাটিতে যমুনা নদীর পানি বাড়ছে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৫ দিন ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বাড়তে পারে। তবে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
ওদিকে রাজশাহী বিভাগে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে, তবে তা এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ বিভাগে আত্রাই, বাঙ্গালি, করতোয়া ও ছোট যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। অন্যদিকে মহানন্দা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ
রংপুরে আকস্মিক বন্যায় অর্ধশতাধিক গ্রাম পস্নাবিত হয়ে হাজারও মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। রাস্তাঘাট ডুবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকায়। পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোও ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ছাড়া ভাঙন-আতঙ্কে দিন পার করছেন নদীপাড়ের হাজারও মানুষ।
পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তার আশপাশে রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্ণীটারী, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা, পাওটানার প্রায় ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো বন্যার কবলে পড়ল তিস্তাপাড়ের মানুষ।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, সোমবার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাউনিয়ায় বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। চরঅধু্যষিত গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে গেছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে কোনও বৃষ্টিপাত হয়নি। অন্যদিকে উজান থেকেও পানি আসেনি। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এখন চর এলাকায় কোনো গ্রামে পানি নেই।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না জানিয়েছেন, বন্যাপস্নাবিত এলাকা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
কুড়িগ্রামের ধরলায় তীব্র ভাঙন
কুড়িগ্রামে বন্যা আর নদী ভাঙনে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলার এক প্রান্তে তিস্তার বন্যা আরেক প্রান্তে ধরলায় চলছে তীব্র ভাঙন। গত তিনদিনে ধরলার ভাঙনে জেলার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবারের বসতি ধরলার গর্ভে বিলীন হয়েছে। রোববার রাতে নদীগর্ভে চলে গেছে এলাকার প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসার প্রথম আশ্রয়স্থল খুটিরকুটি আকেল মামুদ কমিউনিটি ক্লিনিক।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়নের গত তিনদিন ধরে ধরলার তীব্র ভাঙন চলছে। ভাঙনে একের পর এক বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। খুটিরকুটি, রসুলপুর ও কবিরাজপাড়া গ্রামের কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। রোববার রাতে ধরলার ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে ৪নং ওয়র্ডের খুটিরকুটি আকেল মামুদ কমিউনিটি ক্লিনিক। ধরলার তীব্র স্রোত আর আগ্রাসী ভাঙনে ঝুঁকিতে আছে ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুদিরকুটি আব্দুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। ভাঙনের তীব্রতায় ঝুঁকিতে থাকা অর্ধশতাধিক পরিবারে হাহাকার তৈরি হয়েছে। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বসতভিটা থেকে ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
ইউনিয়নের বাসিন্দা ও সংগঠক মিজানুর রহমান মন্ডল বলেন, 'ভাঙনে সব শ্যাষ হয়ে যাইতেছে। ২নং ওয়ার্ডের আল আমিন বাজার থেকে খুঁটিরকুটি বাজার হয়ে কবিরাজপাড়ার শেষে পর্যন্ত তীব্র স্রোত আর ভাঙন। ঘরবাড়ি, মসজিদ, ক্লিনিক কিছুই থাকতেছে না। ঠেকাতে না পারলে এলাকা শেষ হয়ে যাবে।'
ভাঙনে শুধু কৃষক আর দিনমজুর নন, ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরাও ভিটে হারাতে বসেছেন। তিনি বলেন, 'গত দুই তিনদিনে আমার আপন ভাইয়ের বসতিসহ কমপক্ষে ৪০টি পরিবারের ভিটেমাটি নদীতে গেছে। আমার ভিটার অনেক গাছপালা রক্ষা করতে পারিনি। এখন বাধ্য হয়ে ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছি। কোথায় গিয়ে উঠবো এখনো ঠিক করতে পারিনি। আপাতত জিনিসপত্র রাস্তায় রাখতে হচ্ছে।'
এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউর রহমান বলেন, 'যেভাবে সরকারি সম্পত্তিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙনের কবলে পড়েছে, তাতে আমি নিজেই আতঙ্ক বোধ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দুই দিন ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলে আসছি। আমি আবারও যোগাযোগ করছি। নিজেও ভাঙন এলাকায় যাব।'
জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, 'আমি খবর পেয়েছি। ওখানে কমিউনিটি ক্লিনিক নদীতে চলে গেছে। ভাঙন প্রতিরোধে পাউবোকে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিতে বলেছি।'
পাউবো, 'কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, 'ভাঙনের খবর পেয়েছি। ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে।'
৪ দিন বৃষ্টির আভাস
আগামী ৪ দিন সারাদেশে টানা বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সোমবার আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, 'আগামীকাল (মঙ্গলবার) থেকে সারাদেশে টানা বৃষ্টি শুরু হবে, যা ৪ তারিখ পর্যন্ত চলবে। বিশেষ করে সিলেটে ভারী বৃষ্টি ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। আর দেশের অন্য জায়গায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।'
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে সিলেটে ১১৩ মিলিমিটার। এসময় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় মোংলায়, ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।