'বিদ্বেষমূলক ট্যাগ' সমাজে সংঘাত তৈরি করছে : শিক্ষক নেটওয়ার্ক
প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত কমিটি থেকে দুই সদস্যকে অপসারণের দাবি ওঠায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের এই উদ্বেগ জানানো হয়।
সেখানে শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য রুশাদ ফরিদী বলেন, 'উনাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু উনাদের বিদ্বেষমূলক ট্যাগ দেওয়া- যেমন ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী বলে তাদের বাদ দিতে হবে; এ ধরনের দাবিগুলো সমাজে অস্থিরতা, সংঘাত তৈরি করে এবং করছে। এগুলো আমরা স্বৈরাচারী আমল থেকে বের হয়ে এসে দেখতে চাই না।'
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে সম্প্রতি ১০ সদস্যের সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফাকে 'ধর্মবিদ্বেষী' আখ্যা দিয়ে ওই কমিটি থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, 'জাতির ওপর থেকে এতবড় জগদ্দল পাথর সরানোর পরও আমরা যদি অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জায়গায় চলে যাই।
এই কমিটিতে তাকে সরাতে হবে, ওই কমিটিতে তাকে কেন রাখা হলো-এসব না করে সরকারকে কাজ করতে দিন।'
শনিবার বাংলাদেশ
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'জুলাই গণ-অভু্যত্থানের চেতনায় কেমন বাংলাদেশ চাই' শিরোনামে এক আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল, যাতে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
তবে শিক্ষক নেটওয়ার্কের এই সদস্যকে 'সমকামিতা সমর্থনকারী' তকমা দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে 'আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত' হওয়ার আশঙ্কায় ওই সভা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের সংবাদ সম্মেলনে রুশাদ ফরিদী বলেন, 'আজকে আমাদের সামিনা লুৎফা ম্যামের এখানে বসে থাকার কথা না। তার ময়মনসিংহে থাকার কথা আলোচনা সভায়। তিনি কেন আজকের সভায় যোগ দিতে পারলেন না, সেটা ভেবে দেখুন।'
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে রুশাদ ফরিদী বলেন, 'যদি দেশে আইনের শাসন থাকে, তাহলে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি কোনো সমস্যা নয়।
আইনের শাসন থাকলে কেউ অন্যায় সুবিধা নিতে পারে না। তবে ছাত্রলীগের রাজনীতি- রাজনীতি নয়, গুন্ডামি।'
ইউনূসকে খোলা চিঠি
দেশব্যাপী অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষী আচরণের বিষয়ে সরকারের নীতিকে 'অস্পষ্ট' বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে খোলা চিঠি দিয়েছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সংবাদ সম্মেলনে ওই চিঠি পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন।
খোলা চিঠিতে বলা হয়, 'বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণি ও পেশাজীবীর স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আপনারা বিশাল এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেশের হাল ধরেছেন। আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা ও বিগত বছরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের কারণে আপনাদের পথ দুর্গম, সেটা আমরা জানি। স্বাধীনতাকামী সবার ধৈর্য প্রয়োজন, সে কথাও আমরা মনে রাখি।'
অধ্যাপক গীতি আরা বলেন, 'অভু্যত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ্য করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে কেবল হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সেসব মানুষের ওপর হামলাও চালানো হচ্ছে।
তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ হিংস্রতায় নিহত হয়েছেন তিনজন মানুষ। অপরাধীদের ধরতে গিয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা হামলায় নিহত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে।'
খোলা চিঠিতে বলা হয়, 'এই ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকারের নির্মোহ ভূমিকা পালন ও আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কাজেই অতি উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণুতা প্রশমনের জন্য; যারা এসব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন- তাদের থামাতে হবে।
তা না করে সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরাই যদি এসব হস্তক্ষেপকারীদের সাহস যুগিয়ে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে কোনো গোষ্ঠীর কথা পালনে বাধ্য করেন, যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাহলে আর এত দামে কেনা জুলাই অভু্যত্থানের কোন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা হলো?'
অধ্যাপক গীতি আরা বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে যে, তারা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবেন এবং অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তাদের অবস্থান তাদের নীতিসমূহের মাধ্যমে কী করে স্পষ্ট করবেন। সহিংস জমায়েতের সংঘবদ্ধ হিংস্রতা থেকে ভিন্ন মত বা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে, তা সুস্পষ্ট করতে হবে।'