রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই খোলা হলো ৪৪ জলকপাট

উজানের ঢল ও বৃষ্টিতে বাড়ছে নদ-নদীর পানি
যাযাদি ডেস্ক
  ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে বেড়ে যায় তিস্তা নদীর পানি। চাপ কমাতে খুলে দেওয়া হয় ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট -সংগৃহীত

উজানের ঢল ও কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে দেশের উত্তরাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খুলে দেওয়া হয়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট। পানি বেড়ে তিস্তা তীরবর্তী নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমিতে পানি উঠতে শুরু করেছে। ফলে এসব এলাকায় বসবাসরত মানুষজন চরম বিপাকে পড়েছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, একটানা বর্ষণে নদ-নদীর পানি বাড়লেও আজ (রোববার) থেকে তা কমে আসতে পারে। এদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আগামী দুদিন থেমে থেমে বৃষ্টির পাশাপাশি তাপমাত্রা বাড়ারও আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী জানান, ডালিয়ায় তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এরফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নদীবেষ্টিত ডিমলা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত দশটি চর।

জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে পানি বাড়তে থাকে তিস্তা নদীতে। এরফলে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই অবস্থানে রয়েছে নদীর ডালিয়া পয়েন্টে।

\হটেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে তিস্তা নদীতে। এরফলে নদীর নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়। ওই এলাকার মানুষজন এখন পর্যন্ত নিরাপদে রয়েছেন, তবে আরও পানি বৃদ্ধি পেলে উঁচু স্থানে চলে আসার প্রস্তুতি নেবেন বাসিন্দারা। এলাকার ৬শ' পরিবার পানি বন্দি বলে জানান তিনি।

পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ডের মধ্যদিয়ে অবস্থান তিস্তা নদীর। এলাকার প্রায় দেড় হাজার মানুষ পানিবন্দি।

ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, শনিবার বিকাল তিনটায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে রেকর্ড করা হয়েছে ৫২.১০ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার দশমিক ৫ সেন্টিমিটার নিচে। এদিকে পানি বেড়ে পস্নাবিত হয়েছে নদী তীরবর্তী খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, টেপা খড়িবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানী, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নসহ বেশকিছু এলাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা-উদ-দৌলস্না বলেন, 'তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুক্রবার রাত থেকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে তিস্তাপাড়ের মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি।'

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা জানান, 'তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি।'

ডালিয়া শাখা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) উপ-প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, 'অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানির চাপ কমাতে এর মধ্যেই তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৭-৮টি চর ও পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি চর এলাকা পস্নাবিত হওয়ার শঙ্কায় আছেন স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে চরাঞ্চলে পানি উঠতে শুরু করেছে।'

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের

বুলেটিনে বলেছে, 'রংপুর বিভাগের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বাড়ছে, অন্যদিকে দুধকুমার নদীর পানি স্থিতিশীল আছে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত দ্রম্নত বাড়তে পারে। পরবর্তী এক দিন পর্যন্ত স্থিতিশীল এবং এর পরের এক দিনে কমতে পারে।'

'তবে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা নদীর পানি সতর্কসীমায় প্রবাহিত হয়ে সংশ্লিষ্ট চরাঞ্চল এবং কিছু নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী দুই দিন ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।'

বুলেটিনে বলা হয়, রাজশাহী বিভাগের গঙ্গার নদীর পানি কমছে ও তার ভাটিতে পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। আগামী দুই দিন গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি ধীর গতিতে কমতে পারে, পরবর্তী এক দিন স্থিতিশীল এবং এর পরের দুই দিন বাড়লেও বিপৎসীমার নিচে থাকতে পারে। সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। পরবর্তী তিন দিনে তা কমতে পারে।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্দ্ধন গ্রামের আজিজুল ইসলাম বলেন, 'শুক্রবার রাত থেকে পানি বেড়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেছে। অনেক কষ্টে আছি আমরা।'

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, 'তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে এর মধ্যেই ১ থেকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সারাদিন টানা বৃষ্টিপাতের পর শনিবারও থেমে-থেমে বৃষ্টি হয়েছে।

লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার রায় জানিয়েছেন, 'বর্তমানে দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত দুইদিনে রংপুর বিভাগের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়েছে।'

অন্যদিকে, পদ্মা ও মহানন্দা নদীর পানি বেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। চরাঞ্চলের অনেকেই তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছেন।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবতাবুজ্জামান-আল-ইমরান জানান, পদ্মা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় পাকা ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের প্রায় ৮০০ পরিবার ও মনাকষা ইউনিয়নের কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নাজির হোসেন জানান, মাষকলাইসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। নারায়ণপুর দারুল হুদা মাদ্রাসায় পানি ঢুকে পড়ায় সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া আগে ভাঙনের শিকার হয়ে যেসব পরিবার নতুন নতুন স্থানে সমতলে বসবাস করছিল, সেসব পরিবারগুলোও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পলাশ সরকার জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা, উজিরপুর, দুর্লভপুর, ছত্রাজিতপুর, ঘোড়াপাখিয়া এবং সদর উপজেলার নারায়ণপুর, আলাতুলী, শাহজাহানপুর ও চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের ১ হাজার ৫৫৯ হেক্টর মাষকালাই, রোপা আউশসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অন্যদিকে গোমস্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পস্নাবিত জমি মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এগুলোর আংশিক ক্ষতি হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানান, রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায়, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে। তবে এই সময়ে সারা দেশের দিন এবং রাতের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে আবহাওয়ার চিত্র তুলে ধরে অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ ভারতের মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে ভারতের আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।

আজ সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এদিনও ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।

সোমবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে