বাজারে ডিমের দাম অস্থিতিশীল। দুই-তিন সপ্তাহ ধরেই ডিম কিনতে কষ্ট হচ্ছে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের। খুচরায় একটি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ১৪ টাকা, হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। তবে পাড়া-মহলস্নার দোকানে একটি ডিম ১৫ টাকাও বিক্রি হতে দেখা গেছে। সে হিসাবে হালি ও ডজনের দাম দাঁড়ায় আরও বেশি। ডজন ১৭০ টাকাও উঠেছে। দাম নাগালে আসছে না বরং আরও অস্থিতিশীল হওয়ার কথা বলছেন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা।
শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ডিমের সঙ্গে সবজি ও মুরগির দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। পেঁয়াজ-আলুর মতো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমারও কোনো সুখবর নেই।
বাজারে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে। সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, যা এখন ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে। সোনালি মুরগির দামও ১০ টাকা বেড়ে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা হয়েছে, যা ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা ছিল গেল সপ্তাহে।
অন্যদিকে বাজারে বেশ কয়েক মাস ধরে চড়া রয়েছে আলু ও পেঁয়াজের দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু ৬০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে এক মাস আগে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া আলু আমদানিতে থাকা ৩ শতাংশ এবং পেঁয়াজ আমদানিতে থাকা ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
অন্যদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের সপ্তাহের তুলনায় বেশ কিছু সবজির দাম কেজি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা করে বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে সবজির সরবরাহ কমেছে। এর প্রভাবে দাম বেড়েছে।
পেঁপে ছাড়া বাজারে ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। তাও ৬০ থেকে ৭০ টাকায় শুধু পটোল মিলছে। ঢ্যাঁড়স, ধুন্দল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, কচুরমুখি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। বরবটি, কাঁকরোল, করলা, বেগুন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এছাড়া বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেশি। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বাজারে আগাম শীতকালীন সবজি শিম বিক্রি হতে দেখা গেছে ২২০ থেকে ২৮০ টাকা ও ছোট ছোট ফুলকপি ৬০ থেকে ৮০ টাকা পিস।
এছাড়া রুই, তেলাপিয়া, পাঙাশের মতো মাছ আগের দামেই বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি (চাষের) রুই ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও পাঙাশ ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়।
বাজারে একজন ক্রেতা আয়নাল হোসেন বলেন, প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না কমালে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের স্বস্তি নেই। এখন সবকিছু যেন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ডিম-আলু-পেঁয়াজসহ অনেক অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসই এখন বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ চড়া।
চট্টগ্রামে সবজির দামে অস্বস্তি
এদিকে চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, নগরীতে চট্টগ্রামে কিছুতেই স্বস্তি ফিরছে না সবজির বাজারে। গত দুই সপ্তাহব্যাপী চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি। সবজি প্রতি সর্বনিম্ন ১০ টাকা করে বাড়ছে প্রতি সপ্তাহেই। যেন সবজির দামে 'আগুন' ঝরছে বাজারগুলোতে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৃষ্টি ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে কাঁচা সবজি নষ্ট হওয়ায় পাইকারি বাজারে আমদানি কম হচ্ছে। আর তাতে আগামী এক মাসেও দাম কমার সম্ভাবনা নেই। আশ্বিন শেষে কার্তিকের শুরুতেও যদি সবজির উৎপাদন না বাড়ে তবে শীতেও চড়া থাকবে সব ধরনের সবজির দাম।
শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন, দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি, রিয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, আগ্রাবাদ ও চৌমুহনীসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এই চিত্র দেখা যায়।
বাজারগুলোতে ৫০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো ধরনের সবজি। বাজারে প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ১২০ টাকা, গোল বেগুন ৮০ থেকে ৯০ টাকা, লাউ ৬০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৭০, চিচিঙ্গা ৬০, কচুমুখি ৬০, বরবটি ১২০ টাকা, পটোল ৬০ টাকা, চালকুমড়া ৭০, ঢেঁড়স ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কাঁকরোল ১২০ টাকা, কলার মোচা ৮০ টাকা, দেশি লতি ৬০ টাকা আর বাঁধাকপি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পেঁপে ৩০, মিষ্টি কুমড়া ৪০, আলু ৫৫, কাঁকরোল ৮০, ঝিঙে ৯০, করলা ১০০, টমেটো ১৬০ এবং কাঁচা মরিচ ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও পাট শাক বিক্রি ৪০ টাকায়, কপি শাক ৩০ টাকা, লাল শাক বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা করে। ঢেঁকি শাক বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। কুমড়া শাক ৪০ থেকে ৫০ টাকা, মুলা শাক ৪০ টাকা।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে রুই, কাতলা মাছ ৩২০ টাকা, কালিবাউশ ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ টাকা, লইট্যা ১৭০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, টেংরা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, বেলে ৪০০ থেকে ৫৮০ টাকা, বোয়াল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, রূপচাঁদা ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
চৌমুহনী বাজারে পোয়া ৩০০, নারকেলি ২৪০, লইট্টা ২০০, রুই ৩৮০, কাতল ৩২০, পাঙাশ ১৭০-২০০, তেলাপিয়া ২০০-২২০ এবং পাবদা ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অপরিবর্তিত রয়েছে মাংসের দাম। নগরের বাজারগুলোতে গরুর মাংস ৭৮০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি এবং দেশি মুরগি ৫৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রিয়াজউদ্দিন বাজারে হাঁসের ডিম ডজনপ্রতি ২০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৯০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা ও খাসির মাংস ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাজারে পেঁয়াজ ১১০ টাকা, ছোট দানার মসুরের ডাল ১৩৫ টাকা, বড় দানার মসুর ১১০ টাকা, বড় মুগ ডাল ১৪০ টাকা, ছোট মুগ ১৮০ টাকা, খেসারি ডাল ১০০ টাকা, বুটের ডাল ১৩০ টাকা, ছোলা ১১৫ টাকা, মাসকলাইয়ের ডাল ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা, খোলা চিনি ১৩০ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১১৫ টাকা, পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের মধ্যে পুষ্টি ৮০০ টাকা, এস আলম ৭৯০ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এলাচি ৪২০০ টাকা, দারুচিনি ১৫০ টাকা, লবঙ্গ ১৬০০ টাকা, সাদা গোল মরিচ ১৬০০ টাকা ও কালো গোল মরিচ ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
বাজার করতে আসা মোহাম্মদ হোসেন লিকু বলেন, 'আমি রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকেই মাছ-সবজি কিনি। এখানে দাম কিছুটা কম পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দেখছি দাম কম নেই, বরং অন্যান্য বাজারের চেয়ে এখানে আরও বাড়তি। এখানে মাসখানেক আগেও যে সবজি ৩০-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেগুলো এখন কোনোটা ৫০, কোনোটা ৭০ টাকা হয়ে গেছে।'
বহদ্দারহাট বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. ইউসুফ বলেন, এক সপ্তাহ আগে পাইকারিতে ঢেঁড়স আনছি ৪০ টাকা করে। আমরা খুচরায় বিক্রি ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। আর এই সপ্তাহে আমাদেরই পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়। বৃষ্টি হওয়ায় ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে সরবরাহ নেই। সরবরাহ কম থাকায় চাহিদাও বেড়ে যায়। এছাড়া আমরা বেশি দামে কিনলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করেই চুপ হয়ে গেছে। দাম নির্ধারণের পর সেটা বাস্তবায়নেও দ্রম্নত পদক্ষেপ জরুরি। এটা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, আমরা কাজ করছি, বাজার তদারকি অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু আমাদের লোকবল কম, আমরা চেষ্টা করছি উৎপাদক পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও পরিবেশকসহ সবধরনের ব্যবসায়ীদের ক্রয়-বিক্রয়ের রশিদ নিশ্চিত করতে। এটা হলে বাড়তি দামে বিক্রি বন্ধ হবে।