ডেঙ্গু পরিস্থিতি

হাসপাতালে বাড়ছে শিশু রোগীর সংখ্যা, কেউ আক্রান্ত দ্বিতীয়বার

গত বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রতি ছয়জনের একজন শিশু :ইউনিসেফ

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
চলতি সেপ্টেম্বরে এসে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বয়স্ক রোগীর পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে শিশু রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছে দ্বিতীয়বারও। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। ইউনিসেফ বলছে, গত বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রতি ছয়জনের একজনই ছিল শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। রাজধানীর পীরেরবাগের পাঁচ বছরের শিশু মুনতাসিম তাহমিদ দেড় মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাকে নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে তার পরিবার। তাহমিদের পাশে ছিলেন তার মা তাহমিনা খাতুন। তিনি বলেন, 'আগস্টের প্রথম সপ্তাহে জ্বর হয়েছিল ছেলের। সে সময় পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। চিকিৎসায় সুস্থও হয়ে যায় সে। তবে গত শুক্রবার আবার জ্বর আসে। গত শনিবার সকালে হাসপাতালে এলে ডাক্তার পরীক্ষা করাতে দেয়। ডেঙ্গু ধরা পড়লে রোববার তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। তার জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হচ্ছে প্রচন্ড- এটাই সমস্যা।' চিকিৎসকরা বলছেন, বর্ষার শেষ দিক থেকে শরৎজুড়ে সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এবারও পরিস্থিতি তেমনই। আগস্ট থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে, যার মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু। স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর দেশে যত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রতি পাঁচজনের একজনের বয়সই ১৫ বছরের কম। কারও কারও কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারও ডেঙ্গু হচ্ছে বলে হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে। এদিকে, শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চালু করা হয়েছে বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নার। গত সোমবার পর্যন্ত ভর্তি ২৫টি শিশু রোগীর মধ্যে দু'জন নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে ছিল। শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে একজন মরিয়ম আলম, যার বয়স মাত্র এক বছর। তার অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে শরীয়তপুর থেকে তাকে এখানে এনে ভর্তি করা হয়েছে। মরিয়মের মা আসমা আক্তার বলেন, 'মেয়েটির প্রচন্ড জ্বর হয়, তাপমাত্রা বেড়ে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে যায়। শরীয়তপুরে ডাক্তার দেখাইছি। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর তারা বলল, ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য। এখানে ভালো চিকিৎসা হবে।' বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, 'এক সপ্তাহ ধরে দেখছি ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সংখ্যাটি গত বছরের মতো নয়, কিন্তু প্রস্তুতি হিসেবে আমরা ডেঙ্গু কর্নার করেছি।' পেট ব্যথা, প্রচন্ড জ্বর, বমিসহ বিপদ চিহ্ন থাকলেই তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, 'বাকিদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ এবং বাসায় নিয়ে কী করতে হবে, তা লিখে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। শিশুর বাবা-মাকে বলা থাকে আমাদের ফিভার ক্লিনিকে এসে ফলোআপ করিয়ে যাওয়ার জন্য।' হাসপাতালের পরিসংখ্যানে অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত এখানে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ২১০টি শিশু, তাদের মধ্যে ৮৩ জনই সেপ্টেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে ভর্তি হয়েছে। এছাড়া জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রম্নয়ারিতে ৬, মার্চে ১০, এপ্রিলে ৭, মে-তে ১৩, জুনে ৫, জুলাইয়ে ৩১ এবং আগস্ট মাসে ৪৫ জন শিশু ডেঙ্গু নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। ভর্তি শিশুর মধ্যে ৫ জনের মৃতু্য হয় চলতি বছর, তাদের তিনজনই আবার মারা গেছে চলতি মাসে। শিশু হাসপাতালের অদূরেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তির সংখ্যা। বুধবার পর্যন্ত এখানে ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ছিল, যার মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে ছিল ১৮ জন। ঢাকার অদূরে সাভারের জামগড়া থেকে আবু সাঈদ শাকের নামে আড়াই বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন তার পিতামাতা। শাকেরের বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'গত রোববার ছেলের জ্বর আসে। তার শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছিল। সাভার স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দেখে পরীক্ষা দিলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ডাক্তাররা ঢাকায় নিয়ে আসতে বললে সোমবার দুপুরের পর এখানে এনে ভর্তি করাই। রাতে একবার তার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন। এখন শরীর কিছুটা ভালো।' শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আফরোজা বলেন, এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে আসা শিশুদের বেশির ভাগেরই সাধারণ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ এই চার ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ২০২৩ সালে শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ ও আইসিডিডিআর'বি যৌথ গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানানো হয়েছিল, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ 'ডেন-২' ধরনে এবং বাকি ১৩ শতাংশ শিশু 'ডেন-৩' ধরনে আক্রান্ত। চলতি বছর শিশুদের কত শতাংশ কোন ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, 'আমরা এবার অ্যাজ এ হোল সেরোটাইপ করেছি। সেখানে দেখা গেছে এ বছর ডেন-২ তে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। 'ডেঙ্গুর সেরোটাইপ চারটি। কেউ যদি প্রথমবার ডেন-১ এ আক্রান্ত হয়, এরপর ডেন-২ বা ডেন-৩ তে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার ইনফেকশনের মাত্রাটা বেশি থাকে। আবার প্রথমবার ডেন-১ এ আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয়বার একই ধরনে আক্রান্ত হলে সিভিয়ারিটি কম থাকে।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১৩৩ জনের মধ্যে ২১ জন শিশু। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে মাঠে রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলে মাঠে কাজ করছেন ৩২১৪ জন কর্মী। মন্ত্রণালয় বলছে, চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের এক জরুরি সভায় ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে, যারা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাব, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভায় মশক নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড়ভাবে তদারকি করছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়াতে মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃতু্যও হয় এ বছর। গত বছরের ডিসেম্বরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রতি ছয়জনের একজন শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।