খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের ঘটনায় 'সিএইচটি বস্নকেড' নামে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ডাকা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের তৃতীয় দিন সোমবার অবরোধের সমর্থনে বান্দরবানে কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। অবরোধের দ্বিতীয় দিন রোববার রাতে রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করায় সোমবার জেলার জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে টানা অবরোধে স্থবির হয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ির জনজীবন। শহরে টমটম-অটোরিকশা চলাচল করলেও বন্ধ ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃজেলা গণপরিবহণ। এতে বেকায়দায় পড়তে হয় জরুরি কাজে বাইরে আসা মানুষদের। অন্যদিকে, গত চারদিন ধরে বিদু্যৎবিহীন রয়েছে পর্যটন এলাকা সাজেক। অবরোধের কারণে সেখানে আটকে পড়া প্রায় ১৫শ' পর্যটক খাবার ও পানি সংকটে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বালানি, খাবার ও পানি সংকট নিরসনে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
জানা যায়, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘর্ষের ঘটনায় বাস, অটোরিকশা ও ট্রাক ভাঙচুর এবং শ্রমিক আহত হওয়ার প্রতিবাদে এবং এ ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেয় রাঙামাটি পরিবহণ মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। এই হামলায় তাদের ১০টি ট্রাক, তিনটি বাস এবং অসংখ্য অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি। এতে সাতজন চালক গুরুতর আহত হন।
তবে অবরোধ চলাকালে রোববার রাতে জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খানের সঙ্গে পরিবহণ মালিক সমিতির আলোচনার ভিত্তিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। এর আগে প্রত্যাহার করা হয় ১৪৪ ধারা। ফলে সোমবার সকাল থেকে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ছেড়েছে দূরপালস্নার যানবাহন। খুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি স্থানীয়দের। ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান রয়েছে।
অবরোধের তৃতীয় দিন সোমবার বান্দরবানে অবরোধ বাস্তবায়নে কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা সবকিছু খোলা রয়েছে। অবরোধ না থাকায় বান্দরবান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারমুখী সব ধরনের গণপরিবহণ যথানিয়মে চলাচল করেছে।
স্থবির খাগড়াছড়ির জনজীবন :স্টাফ রিপোর্টার, খাগড়াছড়ি জানান, টানা অবরোধের ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে জেলার জনজীবন। তবে অবরোধের মধ্যেও সোমবার স্থানীয় বাজারগুলোতে বাঙালি ও পাহাড়িদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করার মতো।
অবরোধের তৃতীয় দিন সোমবার খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। শহরকেন্দ্রিক টমটম ও অটোরিকশা চলাচল করলেও বন্ধ ছিল অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ। এদিকে ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কর্মসূচি সফল করতে নেতাকর্মী, সমর্থকসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
সোমবার সকালে খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা সাজেক সড়ক, পানছড়ি, রামগড়, মানিকছড়ি সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন অবরোধকারীরা। তবে অবরোধকে কেন্দ্র করে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
খাগড়াছড়ি সদর থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা জানান, অবরোধে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনী ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
বিদু্যৎহীন সাজেক, সংকটে ১৫শ' পর্যটক :এদিকে, রাঙামাটির সাজেকে গত চার দিন ধরে বিদু্যৎ না থাকায় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় খাবার ও খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সেখানে আটকেপড়া প্রায় ১৫শ' পর্যটক। সোমবার দুপুরে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরিন আক্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পর্যটক আল-আমিন বলেন, 'খাবার পানির সংকটে আছি। গত দুই দিন ধরে বিদু্যৎ নাই, নেটওয়ার্কও নাই। এখানে অকটেনের মাধ্যমে যে জেনারেটর চলবে তাতেও জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। হোটেলে গেলে সেখানেও খাবার নাই। জীবন বাঁচাতে আমরা ঝরনার পানি পান করে বেঁচে আছি। খুব ভয়াবহ অবস্থায় আছি। এই মুহূর্তে আমাদের একটাই চাওয়া, সুস্থভাবে বাসায় ফিরে যাওয়া।'
সাজেকের এক কটেজ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'গত ১৮ তারিখে দীঘিনালা সংঘর্ষ ঘটনার পর থেকেই বাঘাইছড়ি ও সাজেক কোথাও বিদু্যৎ নাই। যার ফলে ব্যবহারের পানি-খাবার পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। হোটেলগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার নাই।'
কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ন দেব বর্মণ বলেন, 'খাবার ও পানি সংকট নিরসনে কাজ করছি। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, দ্রম্নতই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'
রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরিন আক্তার জানান, গত ১৮ তারিখে দীঘিনালায় সংঘর্ষের ঘটনায় বিদু্যৎকেন্দ্রের ক্ষতি হয়। যার ফলে দীঘিনালাসহ বাঘাইড়ি উপজেলা বিদু্যতের সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলত বৃহস্পতিবার শুক্রবার ও শনিবার এখানে পর্যটক বেশি হয়। এই চিন্তা থেকে ব্যবসায়ীরা বেশি খাবার মজুত করেননি। মাছ-মাংস নেই। তবে সবজি আছে। তা দিয়ে আপাতত চলা যাবে। আর জ্বালানির ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫শ' পর্যটক সেখানে আটকে আছেন। অবরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া নিরাপদ হবে না। এর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো এমন ২০-২৫ জন পাঁচটি ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ভাড়া করে চলে গেছেন।
প্রসঙ্গত, ১৮ সেপ্টেম্বর ভোরে খাগড়াছড়ি জেলার পানখাইয়া পাড়ায় মোটর সাইকেল চোর সন্দেহে মো. মামুন (৩০) নামে এক যুবককে পেটানো হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মামুন মধ্য শালবাগান এলাকার মৃত নূর নবীর ছেলে। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর জেলার দিঘীনালা উপজেলার লারমা স্কোয়ার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর জেরে বিকালে লারমা স্কয়ারের বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ৫০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। আহত হন পাঁচজন। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলা শহরের নারানখাইয়া স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। রাতের সহিংসতায় রুবেল (৩০), জুনান চাকমা (২০) ও ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) নামে তিনজন নিহত হন।
এ ঘটনার উত্তাপ পরদিন রাঙামাটি শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে জেলা শহরে শত শত পাহাড়ি জনতা মিছিল বের করে। সেই মিছিল থেকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বনরূপা এলাকার দোকানপাট ও স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। পরে দুপুরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
এ ঘটনার জেরে ৭২ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।